রাজধানীর মোহাম্মদপুর আল-মারকাজুল ইসলামের সামনে করোনায় মৃত রোকেয়া বেগমকে গোসল করাতে অপেক্ষা করছেন স্বজনরা। রাতে রাজধানীর বেসরকারি মেডিকেল পপুলার হাসপাতালে মারা যান তিনি।
বেলা ১২টার কিছু পর অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে এলেও তখনও পাননি সিরিয়াল। কখন রোকেয়া বেগমকে গোসল করিয়ে গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জে নিয়ে কবর দেবেন সেই চিন্তায় ব্যাকুল স্বজনেরা।
এই দীর্ঘ অপেক্ষায় রোকেয়া বেগমের দুই স্বজন একবার রাস্তার ওপারে যাচ্ছেন তো আবার এপার আসছেন ,কখন সিরিয়াল আসবে এটা দেখতে। মাঝে মাঝে সিরিয়াল ভেঙে অন্য কোনো মরদেহ আগে ঢোকানো হয় কিনা সেদিকেও রাখছেন নজর।
একই অবস্থা বাগেরহাটের সাহাবুদ্দিনের। করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাসাতেই মারা যান মোড়েলগঞ্জ উপজেলার এই বয়োবৃদ্ধ। বেলা আড়াইটার দিকে তাকে গোসল করাতে নিয়ে আসেন স্বজনেরা। কিন্তু সিরিয়াল দেখে কপালে চিন্তার ভাঁজ স্বজনদের।
মামুন নামে এক স্বজন জানান, গোসল করিয়ে গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটে নিয়ে যাবেন। দূরত্বের চিন্তা আগে থেকেই ছিল। এখন গোসলের সিরিয়াল নতুন করে দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে।
স্বজনদের মতে, গোসলের সিরিয়াল নিয়েই যেখানে কপালে চিন্তার ভাঁজ; সেখানে শোক প্রকাশের সময় কোথায়!
বেলা দুইটা থেকে তিনটা- এই এক ঘণ্টায় সেখানে আসে আরও তিনটি মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স। প্রতিদিন গড়ে চল্লিশটির মতো মরদেহ গোসল করানো হচ্ছে রাজধানীর আল মারকাজুল ইসলামে। একটি বিদায় না দিতেই হাজির আরও একাধিক মরদেহ। মাঝেমাঝেই জটলা বাঁধছে মৃতদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্সের।
করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দীর্ঘ হচ্ছে মরদেহের মিছিল। শোকের মাতম ভুলে স্বজনরাও ব্যস্ত মরদেহের গোসলের সিরিয়াল পাওয়া নিয়ে।
কখনও কখনও আগে সিরিয়ার পাওয়া নিয়েও বিপত্তি বাঁধে সংস্থাটির কর্মীদের সঙ্গে। তখন তাদের বুঝিয়ে সিরিয়াল অনুযায়ী গোসল সম্পন্ন করা হয় বলে জানান আল মারকাজুলের কর্মী আবুল হাসান।
তিনি জানান, ‘মধ্য রাত থেকে দুপুর পর্যন্ত মরদেহের চাপ বেশি থাকে। এসময় কোনো কোনো দিন খাওয়ার সময় পর্যন্ত পাওয়া যায় না। কখনও কখনও স্বজনেরা চান আমারটা আগে হোক, তখন দ্রুত করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে তাদের বোঝানো হয়।’
ঢাকার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আল-মারকাজুল ইসলাম বাংলাদেশে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের গোসল ও দাফনের কাজ করছে। তাদের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় জুলাই মাসে তারা ৮৫৮টি লাশ গোসল করিয়েছেন। এরমধ্যে অর্ধশতাধিক দাফন করেছেন রাজধানীর বিভিন্ন কবরস্থানে।
আর চলতি মাসের ৯ তারিখ বিকেল পর্যন্ত ৩৩০ জন করোনায় মৃত ব্যক্তিকে গোসল করিয়েছেন। অথচ জুন মাসে এই পরিসংখ্যানটা যেন নেহাতই কম। ওই মাসে সংস্থাটির কাছে মাত্র ১৫৭টি মরদেহ এসেছিল গোসল ও দাফনের জন্য।
জুলাই মাসের শুরুতে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে চাপও বেড়ে যায় বলে জানান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হামজা শহিদুল ইসলাম।
তিনি জানান, গত দেড় মাস ধরে এত বেশি মৃতদেহ গোসল এবং দাফন করতে হচ্ছে যে পরিস্থিতি সামাল দিতে বেগ পেতে হচ্ছে। এ সময়ে মৃতদেহ গোসল এবং দাফনের জন্য প্রতিদিন ৩৫ থেকে ৫০ টি ম্যাসেজ আসছে তাদের কাছে। অথচ মে এবং জুন মাসে মৃতদেহ গোসল এবং দাফন একেবারেই কমে গিয়েছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে।
তবে এখন ঢাকার বাইরের রোগী বেশি হওয়ায় কবর দেওয়ার চাপ কিছুটা কমেছে। ফলে কর্মীরা এখন গোসলের কাজে বেশি মনোযোগ দিতে পারছে। প্রতিটি মরদেহ গোসল করাতে সর্বনিম্ন ২০মিনিট সময় লাগছে বলে জানান হামজা শহিদুল ইসলাম।
কাজের শুরু থেকেই মারকাজুল ইসলামের সব ধরণের সামগ্রী স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সরবরাহ করা হলেও এখন তা কমিয়ে দিয়েছে বলে জানান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
তিনি জানান, ‘মরদেহ বহন করতে বডিব্যাগ সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। কিন্তু সরকার এখন মাত্র ৪০ শতাংশ সরবরাহ করছে। বাকিগুলো নিজেরাই সংগ্রহ করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।’
জানা যায়, নিজেদের যানবাহনে চলছে সব কাজ। ১৬ জনের দলে সবাই দীর্ঘদিন ধরে ঘরবাড়ি ও পরিবার ছেড়ে এখানেই সেবা দিচ্ছে। সংগঠনের অফিসেই তাদের খাওয়া দাওয়া ও থাকা চলছে।
হাসপাতাল থেকে মরদেহ আনতে গিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে সংস্থাটিকে। রাজধানীর বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স সমিতি কর্তৃক তাদের অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর, চালককে মারধরের মতো ঘটনাও ঘটছে রাজধানীর বড় বড় হাসপাতালগুলোতে।
এতে নিরাপত্তাহীনতায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ এবং নিওরোসায়েন্স হাসপাতালে আল মারকাজুল ইসলামের কোনো অ্যাম্বুলেন্স করোনায় মৃত কোনো ব্যক্তির মরদেহ আনতে পারেন না বলেও আভিযোগ হামজা শহিদুল ইসলামের।
তিনি বলেন, ‘এসব হাসপাতালে মৃতের স্বজনদের নিজ উদ্যোগে আমরা এখানে নিয়ে আসতে বলি। কারো অর্থ সংকট থাকলে আমরা ওই অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়াও দিয়ে দেই।’ এমনকি সরকারের ঊর্ধ্বতনদের জানিয়েও কোনো সুরাহা হয়নি বলেও অভিযোগ তার।
করোনার দুঃসময়ে এই মানসিক সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।