স্বপ্নের মতো বদলে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক
এম. কে. রানা - বার্তা প্রধান ইনিউজ৭১
প্রকাশিত: মঙ্গলবার ১৯শে এপ্রিল ২০২২ ১১:৫০ পূর্বাহ্ন
স্বপ্নের মতো বদলে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতি

এক সময়ে অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলবাসীর জন্য হঠাৎ করে সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো বদলে যাচ্ছে। যদিও এখনো তেমন একটা শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। তবে শিল্পায়নের আগেই বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন পাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। বর্তমান সরকারের হাতে নেয়া বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখে এরই মধ্যে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা শত শত একর জমি ক্রয় করেছেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাটারিচালিত গাড়ি, বিদ্যুৎ সহজলভ্য হওয়ায় ওই অঞ্চলের পর্যটন খাতও ব্যাপক বিস্তৃত হচ্ছে।


এসব শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পদ্মা সেতু, লেবুখালী সেতু, পায়রা বন্দর, পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন, দৃষ্টিনন্দন ফোর লেনের পায়রা সেতুর পাশাপাশি শেরে বাংলা নৌ-ঘাঁটি ও ইপিজেড স্থাপিত হলে পুরো দক্ষিণাঞ্চল পরিণত হবে অর্থনৈতিক জোনে। সবমিলিয়ে একসময়ের অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের মহাসড়কে বাকি রইল শুধু রেলপথ ও গ্যাস। যদিও দক্ষিণাঞ্চলবাসী আশাবাদী দ্রুতই রেল ও গ্যাসের ব্যবস্থাও হবে। কারণ এসব মেগা প্রকল্পের নামকরণ এবং উন্নয়ন অগ্রাধিকারে রয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পের তিনি নিজে যেমন ভিত্তিপ্রস্তর করেছেন, ঠিক তেমনি এগুলোর উদ্বোধনও করছেন নিজ হাতে।


সূত্র মতে, গত বছরের ২৪ অক্টোবর বরিশাল-পটুয়াখালী ও কুয়াকাটা মহাসড়কে লেবুখালীর পায়রা নদীর ওপর দৃষ্টিনন্দন ফোর লেন পায়রা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পায়রা সেতু চালুর ফলে মাওয়া থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ফেরিবিহীন যোগাযোগ শুরু হয়েছে। লেবুখালীর পায়রা সেতুর উত্তরপ্রান্তে স্থাপিত হয়েছে শেখ হাসিনা সেনানিবাস। দক্ষিণপ্রান্তে দুমকীতে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। মহাসড়কের পাশে রয়েছে কৃষি গবেষণা কেন্দ্র। এদিকে গত ২১ মার্চ দেশের সর্ববৃহৎ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।


দেশের সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করায় বিদ্যুৎ নির্ভর ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে দক্ষিণাঞ্চলে। যে কারণে পায়রা সেতু থেকে মহাসড়কের আশপাশের এলাকায় শিল্প-কলকারখানা স্থাপনে জমি কেনার হিড়িক চলছে দেশের বড় বড় শিল্পমালিকদের। শহরের পাশেই স্থাপিত হয়েছে কোস্টগার্ড সিজি বেইজ অগ্রযাত্রা ঘাঁটি।

জানা গেছে, পটুয়াখালী-কলাপাড়া মহাসড়ক থেকে পায়রাবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ৪ কিলোমিটার ফোর লেন সড়ক নির্মাণ, মহাসড়ক থেকে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত ছয় লেন মহাসড়কের কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের সদর উপজেলার আউলিয়াপুর এলাকায় ইপিজেড স্থাপনে জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভূমি জরিপ করে অধিগ্রহণের জন্য ৪ ধারায় নোটিস দেয়া হয়েছে জমির মালিকদের। কলাপাড়া থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত মহাসড়কের দুপাশে জমি ক্রয়ের পর সাইনবোর্ড বসিয়েছে বেশকিছু কোম্পানি।


বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ইপিজেড স্থাপনের জন্য পটুয়াখালীর সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের পচাকোড়ালিয়া মৌজায় ৪১০ দশমিক ৭৮ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ৪ ধারায় নোটিস দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের ক্লাবের (ইনভেস্টর ক্লাব) জন্য কুয়াকাটা মৌজায় ২ দশমিক ২৫ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাগরকন্যা কুয়াকাটায় এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে শতাধিক হোটেল-মোটেল। পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার খাজুরা, গঙ্গামতী, কাউয়ার চর ও এর আশপাশে জমি ক্রয় করেছেন সিকদার গ্রুপ, ইউএস বাংলা, সেঞ্চুরি, বসুধা, ওয়েস্টার্নসহ কমপক্ষে ১৫টি ভারি শিল্পমালিক। এসব স্থানে কোম্পানিগুলো নির্মাণ করবে, বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কলকারখানা ও বহুতল ভবন। কুয়াকাটায় নির্মাণের অপেক্ষায় রয়েছে ১৭ তলা ভবনের ওয়াচ টাওয়ার। মাস্টারপ্লানের আওতায় হবে আধুনিক পর্যটন এলাকা কুয়াকাটা। থাকবে এয়ারপোর্ট, স্টেডিয়ামসহ বহু স্থাপনা।


বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে আরো জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের পায়রা থেকে কুয়াকাটার বিস্তৃত এলাকা ঘিরে পর্যটনভিত্তিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি সমন্বিত মাস্টারপ্লান করতে যাচ্ছে সরকার। যার মনিটরিং করছের স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। যাতে থাকছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক পর্যটন স্থাপনা, শিল্পভিত্তিক বন্দরনগরী, পরিকল্পিত নগরায়ন, যোগাযোগ, অর্থনীতি ও কৃষি খাতে উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা ও দুর্যোগ ঝুঁকিসহ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাভিত্তিক কার্যক্রম।


এদিকে সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের শেষ দিকে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এ সেতুটি চালু হলে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণের সব জেলায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় আর কোন বাধা থাকবে না। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুকে ঘিরে ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুরসহ দক্ষিণের ৬ জেলায় ব্যাপক উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে।


মন্ত্রিপরিষদ সূত্রে জানা গেছে, মূল সেতুর ভৌত অগ্রগতি ৯৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। বর্তমানে সেতুতে কার্পেটিং, ভায়াডাক্ট কাপের্টিং, ওয়াটারপ্রæফ মেমব্রেন, মূল সেতু ও ভায়াডাক্টের মুভমেন্ট জয়েন্ট, ল্যাম্প পোস্ট, অ্যালুমিনিয়াম রেলিং, গ্যাসের পাইপলাইন, ৪শ কেভিএ বিদ্যুৎ এবং রেললাইন নির্মাণের কাজ চলমান। ২০২২ সালের শেষ নাগাদ পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।


এ ব্যাপারে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার আমিন-উল-আহসান বলেন, এ প্রকল্পকে ঘিরে এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নানাভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশেই পায়রা বন্দরটি গড়ে তোলা হচ্ছে। পাশাপাশি এ অঞ্চলে আরো অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এসব প্রকল্প ঘিরে মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে। বিশেষ করে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বন্দরকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবনমানের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সামনে আরো পরিবর্তন আসবে। এরই মধ্যে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্প এলাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ অঞ্চলে ব্যক্তি উদ্যোগকে কেন্দ্র করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। একইসঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগও আসছে।


বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিলেন এই মুজিববর্ষে শতভাগ বিদ্যুৎ দেয়া, তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে তা অনেক দূর এগিয়ে গেল।


পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়ন হওয়ার ক্ষেত্রে যে বাধা সেই বাধা অনেকটা কেটে গেল। পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলে এখন অনেক বড় বড় শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। মংলা বন্দরকে ব্যবহার করার পাশাপাশি আগামী জুন মাসে পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে। সামনে দক্ষিণাঞ্চলের জন্য অত্যন্ত সুদিন অপেক্ষা করছে জানিয়ে তিনি বলেন, অচীরেই দক্ষিণাঞ্চল হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ব্যবসায়িক অঞ্চল।