স্বপ্ন পূরণে আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ, প্রতিপক্ষ নেপাল

নিজস্ব প্রতিবেদক
স্পোর্টস ডেস্ক
প্রকাশিত: রবিবার ১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৮:১২ অপরাহ্ন
স্বপ্ন পূরণে আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ, প্রতিপক্ষ নেপাল

সংবাদ সম্মেলন তখন শেষ। এবার ট্রফির সঙ্গে দুই অধিনায়কের ছবি তোলার আনুষ্ঠানিকতার পালা। দশরথ স্টেডিয়ামের সবুজে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্রফিটা প্রথম ছুঁলেন সাবিনা খাতুন। সবারই তা চোখে পড়ল, বুঝতে পেরে লাজুক হাসি ফুটে উঠল বাংলাদেশ অধিনায়কের মুখে। তবে সাবিনার ওই স্বতস্ফূর্ত মুহূর্তটিতেই যেন ফুটে উঠল, এই ট্রফি জয়ের তাড়না কতটা তীব্র তাদের!


মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম শিরোপার সেই দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা থেকে স্রেফ এক ধাপ দূরে দাঁড়িয়ে এখন বাংলাদেশ।


ট্রফির পাশে ছবি তোলার সময় হাসি ছিল নেপাল অধিনায়ক আঞ্জিলা থাম্বাপো সুব্বার মুখেও। হতাশার অনেক প্রহর পেরিয়ে আবার তারা আসতে পেরেছে আক্ষেপ ঘোচানোর এই মঞ্চে।



এবার নিয়ে পঞ্চমবার সাফের ফাইনালে খেলছে নেপাল। আগের প্রতিবারই ভারতের কাছে হারের তেতো স্বাদ পেয়েছে তারা। এতবার না হলেও স্বপ্নভঙ্গের অতীত সঙ্গী বাংলাদেশেরও। ২০১৬ সালে শিলিগুঁড়িতে ফাইনালে হেরেছিল তারা সেই ভারতের কাছেই।


আগের সব সাফে বিজয়ী ভারত এবার বিদায় নিয়েছে সেমি-ফাইনাল থেকে। এবার ফাইনালে ওঠার পথে গ্রুপ পর্বে ভারতকে প্রথমবার হারিয়েছে বাংলাদেশ। নেপাল প্রথমবার ভারতকে হারানোর স্বাদ পেয়েছে সেমি-ফাইনালে। সোমবার বাংলাদেশ সময় বিকাল সোয়া ৫টায় প্রথম শিরোপা জয়ের স্বপ্ন নিয়ে কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামের আঙিনায় নামবে দুই দল।


দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েদের ফুটবলের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ তো বটেই, কোনো ম্যাচেই নেপালকে এখনও পর্যন্ত হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। ৮ ম্যাচে হার ৬টিতেই, ড্র দুটি।


সাফের সবশেষ দেখায় ২০১৯ সালে বিরাটনগরে সেমি-ফাইনালে স্বাগতিকদের কাছে  ৩-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। গত বছর সেপ্টেম্বরে নেপালে এসে খেলা দুই ম্যাচের একটিতে ছিল ২-১ ব্যবধানের হার, অন্যটি হয়েছিল গোলশূন্য ড্র।


তবে সংখ্যার এসব পিছুটানকে পাত্তাই দিচ্ছেন না বাংলাদেশ কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। টানা চার জয়, প্রতিপক্ষের জালে ২০ গোল দেওয়া, নিজেদের জাল অক্ষত  থাকা, এবার এই অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যানকে সঙ্গীকে করে ফাইনালে এসেছে তার দল। বিশেষ করে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দেওয়ার তৃপ্তি তাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে দারুণ কিছুর।



“আগেও আমরা বলেছি, মেয়েরা প্রতিজ্ঞা করে এসেছে, বিগত দিনে কী হয়েছে না হয়েছে, তার থেকে পরিবর্তনের একটা আভাস দেবে এবং ওই খেলাটাই খেলবে। টুর্নামেন্ট শুরুর আগের সংবাদ সম্মেলনেও আমি বলেছিলাম, আমাদের মেয়েরা ভালো ফুটবল খেলবে। জয় লাভের চেষ্টা করবে।”


“এই টুর্নামেন্টের আগে ভারতের বিপক্ষেও আমরা কখনও জিতিনি। কিন্তু এবার মেয়েরা ওদের বিপক্ষে পুরো ৯০ মিনিট খেলার মধ্যেই ছিল এবং ভালো ব্যবধানে জয়লাভ করেছে। কালকে আরেকটা ভিন্ন দিন, যেহেতু মেয়েরা ভালো ফুটবল খেলে ফাইনালে এসেছে, আমি মনে করি, তারা সর্বোচ্চটা দিয়েই চেষ্টা করবে নতুন কিছু করার।”


একই স্বপ্ন নেপাল কোচ কুমার থাপার চোখেও। ২০১৬ সালে শিলিগুঁড়িতে তার দলকে সেমি-ফাইনাল থেকে ছিটকে দিয়েছিল ভারত। এবার সেমি-ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে মধুর প্রতিশোধ নিয়ে শিরোপা লড়াইয়ে উঠেছে তার দল। ঘরের মাঠের ফাইনালে দর্শক সমর্থন হবে তাদের বড় প্রেরণা। বাংলাদেশকে অবশ্য ঠিকই সমীহ করছেন তিনি।


“এবার নতুন চ্যাম্পিয়নের মাথায় মুকুট উঠবে এবং এটা সবাই জানে। আমরা এই সুযোগ হারাতে চাই না। ৯০ মিনিটের লড়াই শেষে আমরা সমর্থকদের দুঃখ দিতে চাই না। ট্রফি এখন নেপালে এবং এটাকে আমরা নেপালের বাইরে যেতে দিব না।”


“বাংলাদেশ দলের প্রাণশক্তি এবং টিম স্পিরিট ভালো এবং আমরা তাদেরকে শ্রদ্ধা করি। তারা তরুণ দল, আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী, যদি আবহাওয়া ভালো থাকে, আমি আশা করি, আপনারা ভালো একটা ম্যাচ দেখবেন।”


৪০টি আন্তর্জাতিক গোল করা সাবিত্রা ভান্ডারি ডেঙ্গু থেকে সেরে উঠে শনিবার পুরোদমে অনুশীলন করায় নেপালের আক্রমণভাগ ফিরে পেয়েছে পুরো শক্তি।


বাংলাদেশ তাতে ভড়কে যাচ্ছে না। আঁখি-মারিয়া-সাবিনাদের নিয়ে উপভোগ্য ফুটবলের পসরা মেলে বাজিমাত করতে চান বাংলাদেশ কোচ ছোটন। প্রতিপক্ষ দলের সাবিত্রার মতো বাংলাদেশের আক্রমণভাগেও আছে গোলমেশিন সাবিনা খাতুন। লাল-সবুজ জার্সিতে ৩২টি গোলের ৮টিই এবারের সাফে করেছেন সাবিনা। এর মধ্যে আছে দুটি হ্যাটট্রিক।


ছোটনের কিছুটা দুঃশ্চিন্তা সিরাত জাহান স্বপ্নাকে নিয়ে। ভারতের জালে দুটি এবং ভুটান ম্যাচে গোলের দেখা পাওয়া এই ফরোয়ার্ডের ডান পায়ের চোট সেরে ওঠেনি এখনও। ফাইনালে স্বপ্নাকে খেলানো নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত স্বপ্না খেলতে না পারলেও দলের বাকিদের উপর আস্থার কমতি নেই তার।


“ভুটান ম্যাচের পর থেকে এ পর্যন্ত স্বপ্না কিছুটা উন্নতি করেছে। তবে এখনও ওর পায়ে ব্যাথা আছে। তারপরও আমরা ওকে দেখবে। তারপর সিদ্ধান্ত নিব।”


“আমার দলটাই আমার কাছে অনুপ্রেরণা। ওরা দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে আছে। ওদের যে মনোবল, একাগ্রতা, ইচ্ছাশক্তি এবং বোঝাপড়া, এসবই আমাদের বড় শক্তি। প্রতিপক্ষ যে-ই হোক, আমরা আমাদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলব। ভালো ফুটবল খেলব, জয়লাভ করব।”


একই চাওয়া অধিনায়ক সাবিনারও। দেশের প্রথম নারী ফুটবলার হিসাবে বিদেশের লিগে খেলার অভিজ্ঞতা আছে তার। ২৮ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডের চাওয়া, আরেকটি প্রথমের সঙ্গে জুড়ে যাক তার নামটি।


“শুরু থেকে আমি যেভাবে খেলে আসছি, ম্যাচ বাই ম্যাচ আমার সেভাবেই চেষ্টা থাকবে…অবশ্যই চেষ্টা থাকবে অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর। কোচেরাও বলেছেন, ম্যাচ বাই ম্যাচ ভাবতে; যেহেতু আমাদের সামনে ইতিহাস গড়ার একটা সুযোগ আছে, সেটা যেন আমরা অবগত থাকি।”


ইতিহাস গড়তে মুখিয়ে থাকা দুই দলের মধ্যে নেপালের শক্তির জায়গা খেলা হবে তাদের মাঠে, ফলে সমর্থকদের পাশে পাবে তারা। ভারত ম্যাচে হাজার সাতেক দর্শকের চিৎকারে-উল্লাসে অনিতা-গীতাদের উজ্জীবিত করে রেখেছিল সারাক্ষণ।


নেপালী দর্শক নিয়ে প্রশ্ন হতেই বাংলাদেশ কোচ সংবাদ সম্মেলনে দিলেন দারুণ উত্তর, ‘“আমার পেছনেও ১৮ কোটি বাংলাদেশি আছে।”


আর আগের দিনের প্রস্তুতির ফাঁকে এই একই ইস্যুতে সানজিদার জবাবও ছিল চমকপ্রদ, “এখন আর আমরা গ্যালারিতে প্রতিপক্ষের সমর্থকদের দেখে পাজলড হই না।”


সবকিছু মিলিয়ে রোমাঞ্চের দোলা আর আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়ায় দল প্রস্তুত শেষের লড়াইয়ের জন্য। অপেক্ষা এখন কেবল ইতিহাস গড়ার পানে ছুটে চলার।