মেসি-মদ্রিচ: স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখা, নাকি স্বপ্নভঙ্গ?

নিজস্ব প্রতিবেদক
স্পোর্টস ডেস্ক
প্রকাশিত: মঙ্গলবার ১৩ই ডিসেম্বর ২০২২ ০৮:২৮ অপরাহ্ন
মেসি-মদ্রিচ: স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখা, নাকি স্বপ্নভঙ্গ?

বাতাসে বাজছে বিউগলের করুণ সুর। মরুর বুকে পর্দা ওঠা ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো আর্থে’ গত এক মাস যে উৎসবে বুঁদ ছিল গোটা দুনিয়া, সে উন্মাদনার শেষের শুরু। ৩২ দলের টুর্নামেন্ট এসে ঠেকেছে চার দলে। একে একে বিদায় নিয়েছেন ফুটবল আকাশের বেশ কয়েকজন নক্ষত্র। নেইমার কিংবা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো তারকারা এখন দর্শক। তবে এখনও আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসি।


২০১৪ বিশ্বকাপে শিরোপার খুব কাছাকাছি গিয়েও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ফিরতে হয়েছিল। এবার শেষ বিশ্বকাপ খেলতে নামা মেসির জন্যও সোনালি ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখার শেষ সুযোগ। তার হাত ধরে আকাশী-সাদাদের ৩৬ বছরের শিরোপাখরা ঘোচাতে মরিয়া স্ক্যালোনি বাহিনী।


আসরের প্রথম সেমিফাইনালে মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতে লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হচ্ছে ক্রোয়েশিয়া ও আর্জেন্টিনা। লিওনেল স্ক্যালোনির দল শিরোপার আশা বাঁচিয়ে রাখতে যখন বদ্ধপরিকর, অন্যদিকে কোয়ার্টার ফাইনালে টুর্নামেন্টের হট ফেবারিট ব্রাজিলকে হারিয়ে সেমিফাইনালে জায়গা করে নেয়া ক্রোয়েশিয়ার লক্ষ্য টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনাল খেলা।


চলুন জেনে নেয়া যাক দুই দলের লড়াইয়ের আদ্যোপান্ত।


পরিসংখ্যানে সমতা, ব্যবধান বাড়াবে কে? 

আর্জেন্টিনা ও ক্রোয়েশিয়া এখন পর্যন্ত মুখোমুখি হয়েছে ৫ ম্যাচে। যেখানে দুদলের জয়ই দুটি করে। একটি ম্যাচ ড্র হয়েছে। রাশিয়া বিশ্বকাপে নিজেদের সবশেষ দেখায় ৩-০ গোলে জিতেছিল ইউরোপের দেশটি। পাঁচবারের দেখায় দুদলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোল করেছে ক্রোয়াটরা। তাদের ৬ গোলের বিপরীতে আলবিসেলেস্তেদের গোল ৫টি। 


অবশ্য একটা পরিসংখ্যান কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে মেসি বাহিনীকে। চলতি বিশ্বকাপ ছাড়া আর্জেন্টিনা এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠেছে চারবার। যেখানে একবারও হারেনি তারা। ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপের সেমিতে জিতে ফাইনালে উঠেছিল আলবেসিলেস্তেরা। এরপর অবশ্য সেমিফাইনালে উঠতে তাদের সময় লেগেছে ৫৬ বছর। ১৯৮৬, ১৯৯০ এবং ২০১৪ সালের সেমিফাইনাল খেলেছে আর্জেন্টিনা। যেখানে প্রতিবারই জিতেছে তারা।


সম্ভাব্য একাদশ

হলুদ কার্ডের গ্যাঁড়াকলে এ ম্যাচে খেলতে পারবেন না মার্কাস আকুনা ও গঞ্জালো মন্টিয়েল। অন্যদিকে ডি মারিয়া ও ডি পলের ইনজুরি স্ক্যালোনিকে চিন্তায় ফেলছে শুরুর একাদশ সাজানো নিয়ে। তবে দুজন সুস্থ আছেন বলেই জানিয়েছেন আর্জেন্টাইন কোচ। রক্ষণে অন্য দুটি জায়গা পাওয়ার লড়াইয়ে আছেন ক্রিস্টিয়ানো রোমেরো ও নিকোলাস ওতামেন্দি। অবশ্য পাঁচজনের ডিফেন্স তৈরি করলে সেখানে যোগ দিতে পারেন লিসান্দ্রো মার্তিনেজ।


রদ্রিগো ডি পলের সঙ্গে মাঝমাঠ সামলাবেন অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার ও এনজো ফার্নান্দেজ। অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া ও আলেজান্দ্রো গোমেজ শুরু থেকে খেলার আশা করতে পারেন। বিশেষ করে আক্রমণে লিওনেল মেসি ও হুলিয়ান আলভারেজের সঙ্গে ডি মারিয়াকে দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। যথারীতি গোলপোস্টের নিচে থাকবেন ডাচদের বিপক্ষে দুটি পেনাল্টি ঠেকানো এমিলিয়ানো মার্টিনেজ।


আর্জেন্টিনার সম্ভাব্য একাদশ-এমিলিয়ানো মার্তিনেজ; নাহুয়েল মলিনা, ক্রিস্টিয়ান রোমেরো, নিকোলাস ওতামেন্দি, নিকোলাস তাগলিয়াফিকো; এনজো ফার্নান্দেজ, রদ্রিগো ডি পল, ম্যাক অ্যালিস্টার; অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া, লিওনেল মেসি ও হুলিয়ান আলভারেজ।


অন্যদিকে, ব্রাজিলবধ করা একাদশ নিয়েই নামছে ক্রোয়েশিয়া। তাদের ইনজুরির শঙ্কাও নেই। সম্ভাব্য একাদশ: লিয়াম লিভাকোভিচ, জোসিপ জুরানোভিচ, জোসকো জিভারদিওল, দেজান লভরেন, বোর্না সোসা, লুকা মদ্রিচ, মাতেও কোভাচিচ, মার্সেলো ব্রোজোভিচ, ইভান প্যারিসিচ, আন্দ্রে কামারিচ, মারিও পাসালিচ।


মেসি বনাম মদ্রিচ: যে লড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে বিশ্ব

দুজনের নামের অদ্যাক্ষরে আছে মিল। মিল জার্সি নম্বরেও। বিশ্বকাপেও দুজনের ভাগ্যটা প্রায় একই। লিওনেল মেসি যদি হন আর্জেন্টিনার প্রাণভ্রমরা, লুকা মদ্রিচও ক্রোয়েশিয়ার জন্য তাই। কাতার বিশ্বকাপ দুজনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ডুয়েল লড়াইয়ে। এ যুদ্ধে যিনি জিতবেন তিনি পৌঁছে যাবেন অমৃতের ভাণ্ডের কাছে। আর যিনি হারবেন? - অমরত্বের সন্ধান পেয়ে গেছেন তিনিও। আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া সেমিফাইনালে এমনই এক ধ্রুপদী লড়াই হবে লিওনেল মেসি ও লুকা মদ্রিচের মধ্যে।


যে ৪ রেকর্ড গড়তে পারেন মেসি 

ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে হাই-ভোল্টেজ ম্যাচে বেশ কয়েকটি রেকর্ড ভাঙা-গড়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন লিওনেল মেসি। ফুটবল বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ (২৫টি) খেলার রেকর্ড জার্মানির লোথার ম্যাথিউসের দখলে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৪টি করে ম্যাচ খেলেছেন লিওনেল মেসি ও মিরোস্লাভ ক্লোসা। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে নামলেই ক্লোসাকে ছাড়িয়ে যাবেন আর্জেন্টাইন ফুটবল জাদুকর, ধরে ফেলবেন ম্যাথিউসকে।


এ ছাড়া বিশ্বকাপে মেসির গোলসংখ্যা এখন ১০টি।  এরমধ্যে চলতি কাতার বিশ্বকাপেই তার পা থেকে এসেছে চারটি গোল। এ ছাড়া ২০০৬, ২০১৪, ২০১৮ সালে গোল পেয়েছেন মেসি। শুধু ২০১০ সালে তার কাছ থেকে গোল অধরা ছিল। বিশ্বকাপে মেসির সমান গোল আছে সাবেক আর্জেন্টাইন ফুটবলার গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার। অর্থাৎ ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে একটি গোল করতে পারলে বাতিস্তুতাকে ছাড়িয়ে যাবেন মেসি। সে ক্ষেত্রে দেশের হয়ে বিশ্বকাপ মঞ্চে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে যাবেন এলএমটেন।


পাঁচ বিশ্বকাপ খেলামাত্র ছয় ফুটবলারের মধ্যে মেসি অন্যতম। তিনি অধিনায়ক হিসেবে যৌথভাবে সর্বোচ্চ ম্যাচ (১৮) খেলে ফেলেছেন। মেসির ম্যাচে নেতৃত্ব দেয়ার রেকর্ড আছে মেক্সিকোর রাফা মার্কুয়েজের। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে নামলেই সেই নজির ছাপিয়ে যাবেন তিনি। তবে সব রেকর্ড ছাপিয়ে জয়টা নিজেদের করে নিতে চাইবেন ফুটবল জাদুকর।


মেসিদের সামনে বাধার দেয়াল হতে পারেন যিনি

কাতার বিশ্বকাপ শুরুর আগে গোলরক্ষকদের মধ্যে আলোচনায় ছিল অ্যালিসন বেকার, ম্যানুয়েল ন্যুয়ার, থিবো কোর্তোয়া কিংবা এমি মার্টিনেজদের নাম। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে কেউ ঘুণাক্ষরেও হয়তো ভাবেনি দমিনিক লিভাকভিচের নাম। ক্রোয়েশিয়ার ২৭ বছর বয়সী গোলরক্ষকের নামটাও খুব কম লোকই হয়তো জানত। অথচ, বিশ্বকাপের শেষের দিকে এসে তুমুল আলোচনায় ডায়নামো জাগরেবের এই গোলরক্ষক।


সেমিফাইনালে মেসি-মার্টিনেজদের লড়তে হবে দুর্দান্ত লিভাকভিচের বিপক্ষে। ক্রোয়েশিয়ার গোলবারের সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন মহাপ্রাচীরের ন্যায়।তার সামনে প্রতিপক্ষ ফরোয়ার্ডরা যেন সম্মোহিত হয়ে যান। তিনি যেখানে, যেভাবে চান, যেন সেভাবেই বল হাতে তুলে দেন ফরোয়ার্ডরা। দুহাত প্রসারিত করে যখন গোলপোস্ট আগলে ধরেন, তখন পোস্টে বল ঢুকানোর জায়গা খুঁজে পায় না প্রতিপক্ষ। ম্যাচ জিততে হলে আর্জেন্টিনার আক্রমণভাগকে পেরুতে হবে লুভাকভিচ দেয়াল।