তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে যুব সমাজ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। এক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে লাইকি এবং টিকটক-এর ন্যায় প্রাঙ্ক ভিডিও নামক মারাত্মক সামাজিক অবক্ষয়েও যুব সমাজ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। মানুষকে বিনোদন দেওয়ার লক্ষ্যে এহেন ভিডিও তৈরিতে সমাজের এক শ্রেণীর যুবক ও যুবতীর মাঝে এর আসক্তির প্রভাব দিন দিন যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইসলামের দৃষ্টিতে এসব বিনোদনের হুকুম কী?
ইসলামের দৃষ্টিতে বিনোদন থেকে শুরু করে হাসি কিংবা মজার ছলেও মিথ্যা কথা বলা জায়েজ নেই। এ সম্পর্কে হাদিসের একাধিক বর্ণনায় সতর্কতা প্রদান করা হয়েছে।হজরত বাহয ইবনু হাকিম রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমার পিতা তার পিতার সূত্রে আমাকে হাদিস বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি-
ويل للذي يحدث فيكذب ليضحك به القوم ويل له ويل له
‘মানুষকে হাসানোর জন্য যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস।’ (আবু দাউদ)
বিনোদন দিতে এসব ‘প্রাঙ্ক ভিডিও’ নির্মাণে সব সময় সুফলের চেয়ে কুফলের প্রভাবই বেশি। বিভিন্ন পার্ক কিংবা উদ্যানে এ ধরনের ভিডিও নির্মাণ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। অনেকে এমন ভিডিও তৈরিতে কৃত্রিম সাপ, বাঘ কিংবা গেরিলা প্রভৃতি প্রাণীর মুখোশ পড়ে ধোঁকাবাজি ও ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। ফলে, ভুক্তভোগী এই জাতীয় মুখোশকে সত্য মনে করে ভয় পেয়ে দৌড় দিতে গিয়ে গুরুতর আঘাত পায় কিংবা আহত হয়। অবার ভিন্ন দিক হতে আসা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকারও হতে পারে। কেউ আবার বেশি ভয় পেয়ে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।
অথচ এই ধরণের কার্যকলাপ ধোঁকার শামিল এবং ইসলাম ধর্মে সম্পূর্ণ নিষেধ। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য এক হাদিসে ঘোষণা দেন-
ليس منا من غش
‘যে ব্যক্তি ধোঁকা দেয়, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (ইবনে মাজাহ)
এছাড়াও রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলাবস্থায় অনেকেই পেছন থেকে বেলুন ফুটানো বা বাঁশি বাজানোর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভয় দেখিয়ে ভিডিও করার চেষ্টা করে। হঠাৎ সৃষ্ট এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে চলা ব্যক্তির স্ট্রোক হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
স্কুল-কলেজে আগন্তুক শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রায়ই রাস্তায় এমন পরিস্থিতির শিকার হতে দেখা যায়। অনেকে আবার অতিরিক্ত মজা করতে গিয়ে মানুষকে নানাভাবে উপহাস করেও প্রাঙ্ক ভিডিও নির্মাণ করে। এদিকে ভিন্ন প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা অপর ব্যক্তি গোপনীয়ভাবে এর উপর ভিডিও ধারণ করে। এভাবে বিভিন্ন দৃশ্য বর্তমান সময়ে বেশ পরিলক্ষিত হয়। ফলে প্রতিনিয়ত সমাজের অসংখ্য নারী কিংবা পুরুষ এমন বিব্রতকর ও অসহনীয় পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে, যা অত্যন্ত স্পর্শকাতর।
এছাড়াও মানব সমাজের ন্যায় রাস্তা কিংবা বিভিন্ন পার্কে অবস্থানরত নিরীহ প্রাণী যেমন কুকুর, বিড়াল প্রভৃতিও এর ভুক্তভোগী। সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে অনেকেই সমাজে উপহাসের পাত্র হিসেবেও গণ্য হচ্ছে। কোরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিতে এসব নিষিদ্ধ কাজ ও অত্যাচারমূরক অপরাধ। এসব লোক আল্লাহর কাছে জালিম হিসেবে স্বীকৃত। মহান আল্লাহ বলেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا یَسۡخَرۡ قَوۡمٌ مِّنۡ قَوۡمٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّکُوۡنُوۡا خَیۡرًا مِّنۡهُمۡ وَ لَا نِسَآءٌ مِّنۡ نِّسَآءٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّکُنَّ خَیۡرًا مِّنۡهُنَّ ۚ وَ لَا تَلۡمِزُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ وَ لَا تَنَابَزُوۡا بِالۡاَلۡقَابِ ؕ بِئۡسَ الِاسۡمُ الۡفُسُوۡقُ بَعۡدَ الۡاِیۡمَانِ ۚ وَ مَنۡ لَّمۡ یَتُبۡ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ
অর্থ : ‘হে মুমিনগণ! কোনো সম্প্রদায় যেন অন্য সম্প্রদায়কে ঠাট্টা-বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর নারীরা যেন অন্য নারীদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপকারিণীদের চেয়ে উত্তম। তোমরা একে অন্যের নিন্দা করো না, একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। ঈমান গ্রহণের পর (ঈমানের আগে কৃত অপরাধকে যা মনে করিয়ে দেয় সেই) মন্দ নাম কতই না মন্দ! (এ সব হতে) যারা তাওবাহ না করে তারাই জালিম।’ (সুরা হুজরাত : আয়াত ১১)
এমনকি এসব ভিডিও তৈরির মাধ্যমে সমাজে প্রতিনিয়ত নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ বিরোধী কার্যক্রমের ব্যাপক প্রসার ঘটছে। অনুরূপ এমন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অশ্লীলতাকেও উস্কে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় অশ্লীলতা পরিহারের নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে-
وإياكم والفحش- فإن الله لا يحب الفاحش المتفحش
‘তোমরা অবশ্যই অশ্লীলতা বর্জন করবে। কেননা আল্লাহ তাআলা অশ্লীলভাষী ও অশ্লীলতার প্রসারকারীকে পছন্দ করেন না।’ (আদাবুল মুফরাদ)
কোরআন-সুন্নাহর আলোকে উপরোক্ত আলোচনা হতে সহজেই বোধগম্য যে, ‘মানুষকে হয়রানি করে এমন প্রাঙ্ক ভিডিও নির্মাণ করা জায়েজ নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বদা নিষিদ্ধ ও অপরাধমূলক কাজ।
শুধু তা-ই নয়
দেশের সংবিধানের দৃষ্টিতেও ইহা যেকোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রাইভেসি বা গোপনীয়তা লঙ্ঘনের শামিল। যা গুরুতর অপরাধ। তাই মানব সমাজকে হয়রানি করতে ধারণকৃত এসব তথাকথিত প্রাঙ্ক ভিডিও এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক।
পাশাপশি প্রশাসনের উচিত এহেন কার্যকলাপে লিপ্ত বিকৃত রুচির যুবক-যুবতিদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে এর যথার্থ বাস্তবায়ন করা এবং সমাজে ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারে নিশ্চয়তা প্রদান করা।
প্রাঙ্ক ভিডিও নির্মাণের কাজে লিপ্ত উঠতি বয়সী যুব সমাজকে আইনের আওতায় এনে সতর্কবার্তা প্রদান করা, যাতে প্রাঙ্ক ভিডিও এর নামে মানুষের অধিকার হরণের অপচেষ্টায় বা হয়রানির মতো কাজে কেউ লিপ্ত হতে না পারে। পাশাপাশি বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা সর্বস্তরে ইসলামী মূল্যবোধ শিক্ষাদান নিশ্চিত করা। এমনকি সরকারেরও উচিত, আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এমন জন হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধে ভূমিকা পালন করা।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।