পাকিস্তানের বিপজ্জনক রাজনীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: রবিবার ৬ই নভেম্বর ২০২২ ১০:২৮ পূর্বাহ্ন
পাকিস্তানের বিপজ্জনক রাজনীতি

এই মুহূর্তে পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে হত্যা চেষ্টা সেই দেশের রাজনৈতিক সমাজের ভেতরকার ক্ষত আরও একবার সবার সামনে নিয়ে এনেছে। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই সরকারি মদদে এই হামলা হয়েছে শুরু থেকেই বলে আসছে ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)।


তবে ইমরান খান তিনজনের নামই বলে দিয়েছেন। বলেছেন তাকে খুনের জন্য চারজন ষড়যন্ত্র করেছেন এবং এদের মধ্যে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লা এবং সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ফয়সাল নাসির।


ঘটনা যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে দেশের সমস্ত সচেতন নাগরিকই উদ্বিগ্ন হবেন। প্রতিবেশী ও অন্যান্য দেশও উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে, কারণ পাকিস্তানের রাজনীতির স্থিতিশীলতার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রাজনীতি এবং বিশ্ব কূটনীতির সম্পর্ক রীতিমতো ঘনিষ্ঠ ও প্রত্যক্ষ।


ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, ইমরান পাকিস্তানের সবচেয়ে সুশৃঙ্খল ও সম্মানিত প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করছেন। সেনা জনসংযোগ সংস্থা উল্টো ইমরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। অথচ ইমরান নিজেই সেনা সহযোগিতায় ২০১৮ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন।


এই আহ্বান যে, আসলে সরকারকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্দেশ সেটা বুঝতে অসুবিধা নেই, অন্তত পাকিস্তানের রাজনীতি যারা বোঝেন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীই সবচেয়ে সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল।সামরিক বাহিনী ও মৌলবাদীদের চাপে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা দেশ ছাড়ছেন। কোনোটিরই বিচার হয়নি, পাকিস্তানে বিচার হয় না।


ইমরান জানিয়েছেন, তিনি আগে থেকেই জানতেন তার ওপর হামলা হবে। হামলার আগে চক্রান্ত করেই তার নামে বিতর্কিত টেপ প্রকাশ করে তাকে ধর্মবিরোধিতার দায়ে দোষী বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। যাতে ব্যাপারটা এভাবে সাজানো যায় যে, তিনি ধর্মবিরোধিতা করেছেন বলেই তাকে হত্যা করা হলো।


ইমরান যে তিনজনের কথা বলেছেন, তারা সবাই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। অভিযোগও ভয়ংকর। কিন্তু ইমরান জানেন, এসব অভিযোগ পাত্তা দেওয়া হবে না এবং তার কথা মতো এরা পদত্যাগও করবেন না।রাজনৈতিক মিছিলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে একইভাবে খুন হতে হয়েছিল, আরও অনেক হত্যাকাণ্ড নিয়মিত বিরতিতে হচ্ছে।


সামরিক বাহিনী ও মৌলবাদীদের চাপে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা দেশ ছাড়ছেন। কোনোটিরই বিচার হয়নি, পাকিস্তানে বিচার হয় না। তাই ঘটনার বিচার তো দূরের কথা, তদন্তও হবে ভিন্ন পদ্ধতিতে যাতে পিটিআই ও ইমরানকেই দায়ী করা যায়। এটুকু বোঝা যাচ্ছে সরকার, রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর সাথে পিটিআই-এর সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটল।


ইমরান খানকে এই বছরের এপ্রিলে যখন ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল, তখনো তিনি বলেছিলেন আমেরিকার চাপে সেনাবাহিনী তার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। এরপর থেকে আন্দোলনে আছেন ইমরান এবং তার ডাকে লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নামছে বারবার।


ক্ষমতা থেকে ইমরানের বহিষ্কার, তার ওপর গুলি এবং সেনাবাহিনীর দিকে তার অভিযোগের ইঙ্গিত সবই প্রমাণ করে বরাবরের মতোই পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা অতিরিক্ত সেনা-প্রাধান্যে বিপন্ন, গণতন্ত্রের উপর সামরিক প্রভাবে কাতর।পাকিস্তানে সংসদ আছে, কিন্তু শাসক ও বিরোধীর মধ্যে কোনো সংলাপ হয় না। পাকিস্তানের গণমাধ্যম ও সমাজ বিশ্লেষকরাই বলেন, দেশটিতে কোনো রাজনীতি নেই...


এই বাস্তবতা পাকিস্তানের জন্মমুহূর্ত সেই ১৯৪৭ থেকেই এবং আজও তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। পাকিস্তানে সংসদ আছে, কিন্তু শাসক ও বিরোধীর মধ্যে কোনো সংলাপ হয় না। পাকিস্তানের গণমাধ্যম ও সমাজ বিশ্লেষকরাই বলেন, দেশটিতে কোনো রাজনীতি নেই, তবে রাজনৈতিক দল আছে যারা ঘৃণার চাষ করে এবং একে অন্যের অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে আর সেনাবাহিনীর পক্ষ নেয়।


পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দাপটে একের পর এক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল ও মেরুদণ্ডহীন হয়েছে। মৌলবাদী ও জঙ্গি সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়েছে। এর ফল কী, পাকিস্তানের মানুষ সেটা দেখেই চলেছে।


 পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন হয়, তবে এর মাধ্যমে সংকট কাটে না। গণতন্ত্রের গোড়ার বৈকল্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং তাকে যদি রাজনীতি থেকে না সারানো যায়, তাহলে সব নির্বাচনই অসার।ইমরান একজন স্বনামধন্য ক্রিকেট তারকা যার হাত ধরে পাকিস্তান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তার ওপর আক্রমণ তাই স্বাভাবিকভাবেই শুধু পাকিস্তান নয়, বিশ্বকেও নাড়া দিয়েছে।


এপ্রিলে ক্ষমতাচ্যুত হয়েও জুলাই মাসে পাঞ্জাব প্রদেশের আইনসভার ২০টি আসনের উপনির্বাচনে ১৫টিতেই জয় পেয়েছে ইমরানের দল পিটিআই। এরপর থেকেই পাকিস্তানে একটা আওয়াজ উঠছিল যে, ইমরান ক্ষমতায় ফিরবেন। কিন্তু পাকিস্তানে শুধু জনপ্রিয়তা থাকলেই চলে না, ক্ষমতার পথটা সেখানে বরাবরই খুব পিচ্ছিল যেখানে পথ চলতে হয় বন্দুকধারীদের হাত ধরে। 


প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানোর সময় ইমরান জানিয়েছিলেন, বিদেশি ষড়যন্ত্রের কাছে মাথা নোয়াবেন না। লড়াই চালিয়ে যাবেন শেষ পর্যন্ত। শুধু মুখের কথা নয়, ক্ষমতা হারানোর পর আন্দোলনের ময়দানে নেমে প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, রাজনীতির ম্যাচ জিততে লড়াই চলবে তার।


পাকিস্তানের রাজনীতির ধাঁচও অনেকটাই বদলে গিয়েছে কয়েক বছরে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির মতো পরিবার-নির্ভর পুরোনো দলের প্রভাব পাকিস্তান মুসলিম লীগে ক্রমশ কমছে। রাজনৈতিক আনুগত্যের উত্তরাধিকার নয় বা সেনাবাহিনীর পক্ষ নেওয়া নয়, পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে তাদের সমস্যা সমাধানের অঙ্গীকার


কিছুদিন আগেই পাকিস্তানকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর একটি’ বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। প্রশ্ন হলো, সেনাবাহিনী পরিচালিত এই বিপজ্জনক রাষ্ট্র কী নতুন প্রজন্মের আওয়াজ শুনবে?