সেদিন বাবা যখন মুদি দোকানে যাচ্ছিলেন, তিন বছরের মেয়ে হয়তো চকলেটের বায়না ধরেছিল। এক বছরের ছেলেটাও হয়তো আমতা আমতা করে কিছু বলেছিল। গাল দুটোয় আদর দিয়ে বাবা হয়তো বলেছিলেন ‘আচ্ছা’। দুই সন্তানই তাই বাবার পথের দিকে চেয়ে থাকছিল, কখন বাবা কোলে তুলে মুখে চকলেট পুরে দেবেন। কিন্তু সেই বেলা বাবা এলেন না, এলেন না রাতেও। দুই সন্তানকে পিঠে নিয়ে ঘোড়া ঘোড়া খেলা বাবা পরদিনও এলেন না। এলেন বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি), কজন লোকের কাঁধে চড়ে, খাটিয়ায়, সাদা কাপড়ে।
সাম্প্রদায়িক আইন সিএএ ও এনআরসিকে ঘিরে দিল্লিতে দাঙ্গায় প্রাণ হারানো অটোরিকশাচালক মুদাসসির খানের ওই স্বজনদের এ কান্নার ছবি এখন ভাইরাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কেউ সে ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘কাঁদে দিল্লি কাঁদে মানবতা’। কেউ লিখেছেন, ‘এই কান্না বিশ্ববাসীর জন্য অভিশাপ’। আবার কেউ লিখেছেন, ‘এ কান্না ভারতবর্ষের’।কলকাতার প্রখ্যাত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা দাঙ্গার নৃশংসতা নিয়ে প্রতিবেদন করেছে এ ছবিটি ওপরে দিয়েই। শিরোনাম করেছে- ‘এ যেন ইন্ডিয়া-পাকিস্তান বর্ডার’! ‘নরক হয়ে গেল চেনা রাজধানী’।ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, গত ২২ ফেব্রুয়ারি দিল্লির জাফরাবাদে সিএএ-বিরোধীরা রাস্তা অবরোধ করে। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে সিএএর পক্ষে ক্ষমতাসীন বিজেপির মদতপুষ্ট উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা পাল্টা সমাবেশ শুরু করে। এরপরই দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। আর এই বিক্ষোভই সহিংসতায় রূপ নেয় এবং রণক্ষেত্রে পরিণত হয় দিল্লি।
বাবা এভাবে এলেন কেন? তার দেহটা এমন নিথর কেন? নাকে-কানে সাদা ওসব কী গুঁজে দেয়া? ছেলেটা কিছু বলতে না পারলেও মেয়েটার এমন প্রশ্ন বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছিল স্বজনদের। কাঁপা কাঁপা স্বরেই স্বজনরা বললেন, তোমাদের বাবা মারা গেছেন। এই শেষবারের মতো এলেন। এবার গেলে আর কখনো আসবেন না তোমাদের কোলে নিতে, তোমাদের আদর করতে, বুকে জড়িয়ে নিতে।প্রথম বাক্যটা না বুঝলেও ‘আর কখনো আসবেন না’ বুঝে যেন ডুকরে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। এই কান্নায় যেন গাছের পাতা ঝরে পড়ে, ভারী হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। সান্ত্বনা দেবেন কী, মেয়েটার কান্নার সঙ্গে যেন হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন স্বজনরাও। দাফন করতে আসা পড়শীদেরও চোখ টলমল করতে থাকে। স্বয়ং মৌলভী সাহেবও অশ্রু লুকোতে পারেন না। সংঘাত-সহিংসতায় থমথমে অবস্থার মধ্যেই ২৫ ফেব্রুয়ারি নিকটস্থ মুদি দোকানে সদাই করতে যাচ্ছিলেন কর্দমপুরীর বাসিন্দা অটোচালক মুদাসসির খান। কিন্তু উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা তার মাথায় গুলি করে। তখন তাকে নিকটস্থ জিটিবি হাসপাতালে নেয়া হলেও চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন মুদাসসির খানকে।হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত হওয়ার বৃহস্পতিবার তার মরদেহ স্বজনদের বুঝিয়ে দেয়া হয়। এরপর মুদাসসিরের মরদেহ কর্দমপুরীতে তার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। তখনই কান্নায় ভেঙে পড়েন মুদাসসিরের স্ত্রী-সন্তানসহ স্বজনরা।
পরে তাকে নিকটস্থ গোরস্থানে দাফন করা হয়।মুদাসসির খানের মতোই উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের বাঁধানো দাঙ্গায় এখন পর্যন্ত ৩৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। এছাড়া পুলিশের সামনেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-মসজিদসহ মুসলিমদের অসংখ্য বাড়িঘর ও দোকানপাটে বেছে বেছে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে যেন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দিল্লি।বৈচিত্র্যপূর্ণ ধর্ম-বিশ্বাস-সংস্কৃতির মানুষের একসঙ্গে বসবাসের গর্বিত ইতিহাস বয়ে চলা ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন নেমে এসেছে। কেবল মুসলিমরাই নয়, খোদ সনাতন ধর্মের নিম্নবর্ণের দলিতরাও শিকার হয়ে চলেছে গণপিটুনির নামে সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।