বরিশালে কল্লাকাটা আতংক, খতিয়ে দেখছে পুলিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক
এম. কে. রানা - বার্তা প্রধান ইনিউজ৭১
প্রকাশিত: সোমবার ৮ই জুলাই ২০১৯ ১১:১৫ অপরাহ্ন
বরিশালে কল্লাকাটা আতংক, খতিয়ে দেখছে পুলিশ

বরিশালের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের চায়ের দোকানের আড্ডায়, হাট-বাজার, বিদ্যালয় থেকে বাসাবাড়িতে গত কয়েকদিন যাবত একটি নাম আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। আর সেটি হলো ‘কল্লাকাটা বা মাথাকেটে নিয়ে যাওয়া’। এই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দক্ষিঞ্চলের জনপদে। বিভাগের বিভিন্ন জেলা উপজেলার কোথাও না কোথাও শিশু ধরে নিয়ে গলা কাটছে এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের মাঝে। প্রতিদিনই গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে ‘ছেলে ধরা’র খবর আসছে। তবে ঘটনা অনুসন্ধান করতে গেলে তার সুনির্দিষ্ট কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।  পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পরিকল্পিতভাবে কেউ আতংক ছড়াচ্ছে। অন্য কোন উদ্দেশ্যকে প্রবাহিত করার জন্য কেউ আতংক ছড়াচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বর্তমানে বরিশালের বিভিন্ন স্থানে গলা কাটা আতংকের সংবাদ পুরটাই গুজব, আর এরকম গুজব থেকে জনগণকে সচেতন করার জন্য বরিশাল মেট্রো পলিটন পুলিশের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্রচার করা হবে যে, এ সবই গুজব। তবে এমন ভিত্তিহীন খবরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন গ্রামাঞ্চলের শিশু ও অভিভাবকরা। 

‘ছেলে ধরা’ আতঙ্কে গ্রামের শিশুরা বাড়ি থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে। অনেক গৃহকর্তারা শিশুদের বিদ্যালয় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। অপরিচিত লোক দেখলেই মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এতে বিপাকে পড়েছে ভিক্ষুকরা। অপরিচিত কেউ ভিক্ষা চাইতে গেলে গৃহস্থরা ভিক্ষা না দিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এনিয়ে আজব আজব গল্পও ছড়াচ্ছে মুখে মুখে। যা সবই আতঁকে ওঠার মতো। কোন এক সেতুতে নাকি মানুষের কল্লা লাগবে! কেউ শুনেছেন ১০০টি আবার কেউ শুনেছে বিশ হাজার কল্লা। কেউ শুনেছে ত্রিশ হাজার কল্লা দিতে হবে। সে ছোট ছেলে-মেয়ে হোক বা যেকোন বয়সের। কেউ শুনেছে নগরীর রূপাতলী থেকে দু’জনের কল্লা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কেউ শুনেছে ছোট বাচ্চাদের কল্লা নেওয়ার সময় নগরীতে তিনজনকে ও গৌরনদীতে তিনজনকে আটক করেছে স্থানীয় লোকজন। এনিয়ে রীতিমত বাকবিতন্ডাও চলছে। যদিও এসব বিষয়ে কেউ চোখে দেখেননি। সবাই শুনেছেন। আর এই শোনা থেকে আলোচনা এখন ক্রমেই আতংকে রূপ নিয়েছে। ফলে গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতেও সন্তানদের একা ছাড়ছেন না তাদের অভিভাবকরা। সময়ের অভাবে অভিভাবকরা সাথে যেতে না পারলে সন্তানকে স্কুলে পাঠানো হচ্ছেনা। ফলে গত এক সপ্তাহ থেকে বিদ্যালয়গুলোতে শিশু শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমে গেছে। 

শুধু শিশুদের জন্যই নয়, আতংক রয়েছে বড়দের জন্যও। নগরীর ২৬নং ওয়ার্ড হরিণাফুলিয়া এলাকার বাসিন্দা নয়ন হাওলাদার বলেন, একটু রাত করে বাড়িতে ফিরলেই বউয়ের ঝাঁঝালো কথা শুনতে হয়। বাড়িতে না ফেরা পর্যন্ত পরিবারের লোকজন থাকে দুশ্চিন্তায়। এই বুঝি তিনি (নয়ন) বিপদে পড়লো এমন আতঙ্কের কথা বলছেন স্বজনরা। ডেফুলিয়া এলাকার বাসিন্দা কোব্বাত আলী হাওলাদার জানান, তার স্ত্রী শুনেছেন ঘর থেকেও কল্লা কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাদের টিনের ঘর তাই নির্ঘুম রাত কাটে কোব্বাত হাওলাদারের স্ত্রীর। নগরীর ২৭নং ওয়ার্ডের ইন্দ্রকাঠী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, এ ধরণের গুজবে অভিভাবকরা স্বভাবতই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

তবে গত কয়েকদিনে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা কমলেও অভিভাবকদের সংখ্যা বেড়েছে বলেও শিক্ষকরা উল্লেখ করেন। সদর উপজেলার রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নের ধর্মাদী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোঃ হানিফ হাওলাদার জানান, গুজবটি এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। সবার মধ্যেই বিরাজ করছে আতঙ্ক। এ আতঙ্ক এখন ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। সূত্রমতে, গত শুক্রবার রাতে নগরীর ডেফুলিয়া এলাকার নুরু খান মাথায় সাজিতে ‘বড়া’ (বড়শি ) নিয়ে মাছ ধরতে বের হন। রাত ১২টার দিকে ভাঙ্গারপুল নামক স্থান দিয়ে যাবার সময় জানালা দিয়ে এক নারী তাকে দেখে ভয়ে ‘কল্লাকাটা, কল্লাকাটা’ বলে ডাকচিৎকার শুরু করেন। এসময় চারদিক থেকে লাঠি-সোটা নিয়ে স্থানীয়রা তাকে (নুরু খান) ঘিরে ফেলে। ওই নারীর বক্তব্য ছিলো, সাজি ভর্তি কল্লা। অবশেষে দেখা যায় বরশি আর লোকটিও প্রতিবেশি। 

নগরীর আমতলা মোড় এলাকায় গত রবিবার রাতে গলা কেটে নিয়ে দেহ ফেলে রেখে যাওয়ার গুজব ছড়ায়। এছাড়া গত সপ্তাহে নগরীর রূপাতলী এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে এক নারীকে আটক করে পুলিশ। পরবর্তীতে যাচাই করে দেখা যায় ওই নারী মানসিক ভারসাম্যহীন। অপরদিকে কাউনিয়া কালা খাঁ’র বাড়ি এলাকায় ছেলে ধরা সন্দেহে একজনকে আটক করে স্থানীয়রা। থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আসলে ওই ব্যক্তি প্রতিবন্ধী। 

গত রবিবার নগরীর আলেকান্দা রিফিউজি কলোনি এলাকায় স্প্রে দিয়ে এক গৃহিণীর গলায় চাকু দিয়ে আঘাত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয়রা জানায়, সেখানে গত ৩ দিনে স্কুল ছাত্রী সহ ৩ জনকে স্প্রে দিয়ে অচেতন করা হয়েছিলো তবে কে বা কারা এই এরকম করেছে তার কোনো সূত্র এখনো পাওয়া যায়নি। শেবাচিম সূত্র বলছে গত ২দিনে একই এলাকার দুই গৃহবধুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পর পর ৩টি ঘটনার পরে রিফিউজি কলোনি এলাকায় স্প্রে দিয়ে গলাকাটার আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। 

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রিফিউজি কলোনির বাসিন্দা মোঃ ইউসুফ এর মেয়ে স্কুল ছাত্রী টুম্পা ( ১৪) তার নিজ বাসায় লেখাপড়া করার সময় কেউ রহস্যজনকভাবে তার বাসায় প্রবেশ করে তাকে স্প্রে দিয়ে অচেতন করে। এ সময় তার মা পিছন থেকে দেখে ডাকচিৎকার দিলে ঘাতক পালিয়ে যায়। এরপর পরের দিন গত শনিবার সন্ধায় একই এলাকার রুবেলের স্ত্রী রিয়ার বাসায় সেই অজ্ঞাত কেউ প্রবেশ করে এবং তাকে স্প্রে দেওয়ার সময় তার ডাকচিৎকারে ঘাতক পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে রবিবার সন্ধা ৭ টার দিকে স্থানীয় শ্রমিক লীগ নেতা শাহ আলম এর বাসার পিছনের দরজায় দাড়িয়ে থাকে অজ্ঞাত ঘাতক। দরজা খোলা মাত্রই তার স্ত্রী রুবিকে স্প্রে করে মুখোশধারী অজ্ঞাত এক ব্যক্তি। এ সময় ঘাতকের হাতে থাকা চাকুর আঘাতে রুবির গলায় আঘাত লাগে এতে সে সামান্য আঘাত পায় ও চিৎকার দেয় তার চিৎকারে শুনে শাহ আলমের মেয়ে ঘরে ঢুকতেই মুখোশধারী ঘাতক পালিয়ে যায় তখন স্প্রে দেয়ার কারণে রুবি অজ্ঞান হয়ে যায়। পরে তাকে মূমুর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করে শেবাচিমে ভর্তি করে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি সাউথ মোয়াজ্জেম হোসেন ভুঁইয়া, কোতয়ালী থানার এসি মোঃ রাসেল, ওসি নুরুল ইসলাম পিপিএম সহ পুলিশের কর্মকর্তারা। 

অপরদিকে বানারীপাড়ায় স্কুলে মডেল টেষ্ট পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর্বে শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও শিক্ষকরা ছেলে ধরা সন্দেহে বোরকা পরা মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীকে গতকাল সোমবার আটক করেন স্থানীয়রা। পরে উৎসুক জনতা তাকে লাইব্রেরী কক্ষ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মারধর ও চোখ উপরে মেরে ফেলার জন্য ঊদ্ধ্যত হলে পুলিশ তাদেরকে মৃধু লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার পাশাপশি ওই নারীকে উদ্ধার করেন। অপরদিকে বানারীপাড়া বন্দর মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে থেকে জনতার হাতে একজন ছেলে ধরা (গলাকাটা) আটকের খবর (ছবি ও ভিডিও) মুহুর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে উপজেলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে অভিভাবক ও স্কুলগামী কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীর মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। 

অপরদিকে ভোলার চরফ্যাশনে গলাকাটা আতংকে রাত জেগে পাহারা দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। বাবুগঞ্জের ঘটকচর এলাকার রিক্সাচালক রিপন এ প্রতিবেদককে বলেন, “ভাই আপনারা সাংবাদিকরাতো সঠিক খবর জানেন, আমাদের এলাকায়ও ছেলে ধরা আতংক আছে অনেকে”।  নগরীর কাউনিয়ার বাসিন্দা বৃদ্ধ রিজিয়া বেগম বলেন, চারদিকে ছেলে ধরা/কল্লাকাটার খবর পাওয়া যায় তা কি সত্য? তিনি তার পরিবারের নাতি-নাতনিদের নিয়ে আতংকের কথা বলেন। একাধিক অভিভাবকরা জানান, কোথায় নাকি কল্লা দিতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই সন্তানদের সাথে স্কুলে যেতে হচ্ছে। কখনো একা পাঠালে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। তাদের দাবি বিষয়টি গুজব হলেও সরকারের উচিত ভয় কাটানোর ব্যাবস্থা করা। 

এ ব্যাপারে গত রবিবার কাউনিয়া থানা আয়োজিত ওপেন হাউজ-ডে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান (বিপিএম-বার) বলেছেন, এ ধরণের কোন সংবাদ আমাদের কাছে নেই। এটা গুজব উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, মাঝে মাঝে একটি চক্র এ ধরণের গুজব রটায়। গুজবে কাউকে কান দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, তবে খেয়াল রাখতে হবে শিশু পাচারকারী চক্র হয়তো এ সুযোগ কাজে লাগাতে চেষ্টা করবে। তাই সন্দেহজনক কাউকে মনে হলে নিকটস্থ থানা পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করার কথা বলেন তিনি।  এ ব্যাপারে বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার মোঃ সাইফুল ইসলাম জানান, বিষয়টি পুরোপুরি গুজব। আমাদের কাছে এধরণের কোনো অভিযোগ আসেনি। তবে কোনো এলাকায় সন্দেহজনক নতুন লোক দেখলে নিকটস্থ পুলিশকে জানানোর জন্যও তিনি এলাকাবাসির প্রতি আহবান করেন। বিষয়টি পুরোপুরি গুজব দাবি করে পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের ফেসবুক পেজে একাধিক স্টাটাস পোষ্ট করেছেন।  বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান এধরনের আজগুবি গুজবে কান না দেওয়ার জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ করেন।

ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব