সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ তায়ালার। যিনি আমাদের ১৮ হাজার মাখলুকাতের মধ্য হতে একমাত্র শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। একই সঙ্গে তিনি আমাদের মুসলিম জাতির অন্তর্ভুক্ত করে এ পৃথিবীতে মর্যাদা সহকারে স্থান দিয়েছেন। আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ, চিরকৃতজ্ঞ।ইসলাম সকল মানুষের সার্বিক জীবনের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে যে যখনই এসেছে বা আসতে চেয়েছে, তাকেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দুনিয়া ও আখিরাতে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তেমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত হয়েছেন। ইসলামের একজন খাদেম হয়ে ইসলাম ও মানবতার জন্য যে সকল সেবা প্রদান করেছেন, আমি আমার এ লিখনীতে অতি সংক্ষিপ্ত আকারে এর কিছু অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।
জন্ম: হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার অন্তর্গত টুঙ্গিপাড়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন অত্যন্ত সুফি চরিত্রের অধিকারী। বঙ্গবন্ধুর মাতা সায়েরা খাতুনও একজন ধার্মিক মহিলা ছিলেন।শৈশবকাল: ছোটবেলা থেকে শেখ মুজিব ছিলেন দয়ালু ও পরোপকারী একজন বন্ধুসুলভ বালক। বাড়ির সবাই তাঁকে খোকা নামে ডাকত। দরিদ্র শিশু ও দরিদ্র মানুষের জন্য খোকা ছিলেন এক দয়াবান বালক। তাদের সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠত। এমনকি গায়ের কাপড়, মাথার ছাতাও তিনি দান করে দিতেন। এরই নাম মানবতাবাদী খোকা।
ছাত্রজীবন: বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিক ঘেঁষে একটা সরু খাল চলে গেছে, যেটি বাইগার নদী ও মধুমতী নদীর সংযোগ রক্ষা করে। এই খালের পরেই ছিল বড় কাচারি ঘর, আর এই কাচারি ঘরের পাশে বঙ্গবন্ধুর পড়ার ঘর। এখানে তাঁকে মাস্টার, প-িত ও মৌলভী সাহেব পড়াতেন। মৌলভী সাহেব বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে জায়গির থাকতেন এবং তাঁকে পবিত্র কোরআন, নামাজ, রোজা ও আরবিসহ বিভিন্ন মাসাআলা, ইমান, আকিদার শিক্ষা দিতেন। এ জন্যই তিনি শিশুকাল হতে ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত একজন মানুষ। ধর্মপ্রাণ মুসলিম জননেতা। তাঁর কথায় কাজে সর্বদা আল্লাহর নাম বা ইনশাআল্লাহ থাকত।
সাত বছর বয়সে তিনি গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে পিতার কর্মস্থল গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ১৯৮২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ১৯৮২ সালে ভর্তি হন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর এখানে তিনি বিভিন্ন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদ করেন এবং ন্যায্য দাবি আদায়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন।রাজনৈতিক জীবন: ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধু রাজনীতি ও দেশব্রতে যুক্ত হন। ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি বহুবার কারাবরণ করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালির ওপর উর্দুভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ও ছাত্রসমাজ বিক্ষোভ করলে তিনি গ্রেফতার হন।
১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন করার জন্য শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে তাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়, তখন কারাপক্ষ তাঁকে মুক্তি দেয়। আওয়ামী লীগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। এটা শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পারে। তাই ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে আবার তাঁকে গ্রেফতার করে। জেলে থাকা অবস্থায় তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় অনশন পালন করেন।১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলে শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হন। ১৯৫৬ সালে আবার তিনি মন্ত্রী হন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি।
১৯৬৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেওয়া হয়। জনগণের উত্তাল আন্দোলনের মুখে তাকে মুক্তি দেয় পাকিস্তানি জান্তা সরকার। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষে তোফায়েল আহম্মেদ তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত বঙ্গবন্ধুর মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ বিশ্বজগৎ এবং যাবতীয় জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন, তাঁর এ বিশাল সৃষ্টির পেছনে সূক্ষ্ম পরিকল্পনা, নিখুঁত বৈজ্ঞানিক কৌশল ও গভীর তাৎপর্য রয়েছে। ফলে বিশ্বের সবকিছু যথানিয়মে পরিচালিত হচ্ছে। এ বিশ্বে অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে মানুষ অন্যতম, ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি ও বিবেচনায় মানুষ শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টির মর্যাদা লাভ করেছে। যুগে যুগে নবী-রাসুলগণের উপর আল্লাহর বাণী যথা আসমানি কিতাব বা হেদায়েত এসেছে। সেসব কিতাব নাজিল হয়েছে নবী-রাসুলগণের কাওমের মানুষের নিজ ভাষায়। যেমনি করে হযরত মুসা, দাউদ, ঈসা, ইব্রাহীম নবীর ভাষা অনুযায়ী তিবরানি, সুরিয়ানি, হিব্রু ও আরবি ভাষায় যথাক্রমে তাওরাত, যাবুর, ইনজিল ও সহিফাসমূহ অবতীর্ণ হয়। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর আল-কুরআন নাজিল হয়েছিল আরবি ভাষায়। কারণ ছিল, নবী (সা.) ছিলেন আরব, তাঁর কাওমও ছিল আরবি ভাষার।
মহানবী (সা.) মাতৃভাষার প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন এবং মাতৃভাষা শিক্ষার জন্য জোর তাগিদ দিয়েছেন। মাতৃভাষা আল্লাহর দান। যেহেতু মাতৃভাষা আল্লাহর দান, সেহেতু এ ভাষা অন্য কাউকে কেড়ে নিতে দেয়া যায় না। মাতৃভাষার জন্য, মাতৃভূমির জন্য জিহাদ করা একান্ত কর্তব্য। যারা প্রাণ দিবে তাঁরা শহিদ, আর যারা বেঁচে থাকবে তাঁরা গাজী।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত হয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা বুঝে, মাতৃভাষাকে সম্মান দিতে গিয়ে মাতৃভাষা রক্ষার জন্য লড়েছেন। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি যখন ঘোষণা করেন, টৎফঁ ধহফ টৎফঁ রিষষ নব ংঃধঃব খধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ (উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা), তখন বঙ্গবন্ধু তার প্রতিবাদে বলেছিলেন দঘড়, ঘড়’. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ মার্চ পুনরায় ঘোষণা দিলে, সমস্ত ছাত্রসমাজকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভাষাহরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন।ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুকে আটক করে জেলে পাঠানো হয়। কারাবরণ করেন বঙ্গবন্ধু মাতৃভাষার জন্য। এরপর ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময়ও কারান্তরীন ছিলেন তিনি। সেখান থেকে সময়ে সময়ে দিকনির্ধেশনা দিতেন বঙ্গবন্ধু
মাতৃভূমি
ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা ও দেশপ্রেমে জাগ্রত। স্বদেশপ্রেম এক প্রকার পরিশুদ্ধ ভাবাবেগ। ইসলাম নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমকেই প্রকৃত দেশপ্রেম বলে আখ্যায়িত করেছে। দেশপ্রেম ঈমানেরই অঙ্গ। যার ঈমান যত মজবুত সে তত বেশি দেশপ্রেমিক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত হয়ে আপন মাতৃভূমিকে ভালোবেসেছেন। দেশকে ভালোবাসা মানে দেশের মানুষ ও সম্পদকে ভালোবাসা, দেশকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করা। দেশরক্ষার জন্য শত্রুর মোকাবেলা করা, যুদ্ধ করা, জেহাদ করা, সীমানা পাহারা দেয়া ফরজ। বঙ্গবন্ধু এ কাজগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করেন এবং দেশ থেকে শত্রু বিতাড়িত করতে সক্রিয় আন্দোলন করেন। দেশ লুটকারী হানাদার বাহিনী ও পাকিস্তান সরকারকে এদেশ থেকে তাড়াতে, দেশের মানুষকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে রক্ষা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় জেল, জুলুম ও কারাবরণ করেন। তিনি এসব করেছেন আত্মসম্মান বোধ থেকে, ঈমানের দায়িত্ব বোধ থেকে, তিনি অবশ্যই একজন শহীদের মর্যাদা লাভ করে জান্নাতি হবেন। আমি তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সকলের জন্য; মৃত ব্যক্তিদের জান্নাত ও জীবিত ব্যক্তিদের হায়াতে তাইয়্যেবা কামনা করি।
ইসলামের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা
বিশ্বের সকল অঞ্চলে, সকল মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা সহজাত ধর্ম; স্বাধীনতার জন্য আকাক্সক্ষা, উদ্বেগ এবং আকুতি স্বতঃস্ফূর্ত। এ কারণে মানুষ প্রকৃতিগতভাবে স্বাধীনতাপ্রিয়। স্বাধীনতা ছাড়া মানবজীবন কল্পনা করা যায় না। এ জন্য ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতির স্বাধীনতার জন্য মানুষ নিজেদের জীবন কুরবানি দিতেও কুণ্ঠিত নয়। মানুষের মুক্তির ধর্ম ইসলামে স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতার গুরুত্ব অপরিসীম।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার মানুষকে পদানত করতে যতবার অবিচার ও জোরজবরদস্তির আশ্রয় নিয়েছিল, ততবারই মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়েছে। বাঙালির প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা কেড়ে নিয়ে উর্দুভাষা জোরপূর্বক চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, তা রুখে দিয়েছে। এরপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এদেশের জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, শোষণ করেছে বাংলার অর্থসম্পদ। এদেশের অর্থ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে সমৃদ্ধ করেছে। জুলুম, অত্যাচার নিপীড়ন দিনের পর দিন বেড়েই চলছিল। এহেন পরাধীনতার শিকল থেকে বাঙালি জাতিকে রক্ষা করার জন্য এবং আত্মমর্যাদায় বলীয়ান হয়ে ইসলামের আলোকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে নিয়ে পরাশক্তির বিরুদ্ধে জীবনভর লড়ে গেছেন।
তিনি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যান। বিভিন্ন দাবি ও দফার মাধ্যমে স্বদেশী আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা ও দেশ শত্রুমুক্ত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।... রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’
বঙ্গবন্ধুর মহান আল্লাহর উপর এ বিশ্বাস থাকার কারণে মহান মুক্তিযুদ্ধে অল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা হয়েও বিশাল শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র ৯ মাস যুদ্ধ করে বিজয় লাভ করে বাঙালি জাতি। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে, আর হাজারো মা-বোনের সম্ভ্রমের বদৌলতে আমরা পেয়েছি একটি লাল-সবুজের পতাকা। আমাদের তাঁরা উপহার দিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশ। ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতার মর্মবাণী উপলব্ধি করে বঙ্গবন্ধু সারা জীবনের শ্রম আর চেষ্টা-সাধনার বিনিময়ে আমাদের যে স্বাধীন দেশটি উপহার দিয়েছেন, আমরা জীবনের বিনিময়ে হলেও এদেশের মর্যাদা ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখব ইনশাআল্লাহ।
ইসলাম প্রচার ও প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অবদান
স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ইতোপূর্বে বেশ কিছু দেশি-বিদেশি লেখক, সাংবাদিক তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলো নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু একজন খাঁটি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ধর্মীয় জীবন, ইসলাম ধর্মের প্রতি তাঁর অনুরাগ এবং ইসলাম প্রচারে ভ’মিকা নিয়ে আজ অবধি তেমন কোনো লেখা হয়নি। ফলে আমরা বঙ্গবন্ধুর ধর্মীয় চেতনাবোধ, ইসলাম প্রচার ও প্রসারে তার অবদান সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। আমি ইসলামে তাঁর অসামান্য অবদানের কিছু অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
ধর্মীয় জীবনে বঙ্গবন্ধু একজন খাঁটি মুসলিম পরিবারের সন্তান। তিনি সর্বদা আল্লাহকে স্মরণে রাখতেন। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়, কুরআন তিলাওয়াত ও সাওম পালন করতেন। যাকাত ও দান-খয়রাতে তিনি ছিলেন অনন্য। গ্রামের কোনো লোক তাঁর কাছে গেলে তিনি কাউকে খালি হাতে ফেরাতেন না। রমজান মাসে তিনি দেশের আলেম-ওলামাদের দাওয়াত করে খাওয়াতেন, অধিকাংশ সময়ই তিনি ইসলামি পোশাক পরতেন এবং মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতেন।
সামাজিক জীবনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন সমাজসেবক, গরিব দরদি এবং দানশীল মানুষ। সকলের সাথে মিলেমিশে, সবার বন্ধু হয়ে থাকার চেষ্টা করতেন। একজন মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের কষ্ট তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারতেন এবং কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করতেন- এটাই ছিল তার ধর্ম। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অবদান অনস্বীকার্য।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেই ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে এক নির্দেশে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আল্লাহর শক্তিতে বলীয়ান। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়ন করা, অনৈসলামিক কার্যকলাপ বন্ধ করে সঠিক ইসলাম প্রচার করার জন্য তিনি ঈমানি চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন করেন। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধিবাসীর চাহিদা মোতাবেক সারা দেশে এর শাখা অফিসসমূহের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠান সেবা দিয়ে আসছে।
১৯৭৩ সালে রবিউল আউয়াল মাসে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) মাহফিল জাতীয় পর্যায়ে উদযাপন করা হয়। এ মাহফিলে তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান মেহমান হিসেবে উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানমালার শুভ উদ্বোধন করেন। বায়তুল মোকাররম মসজিদের সৌন্দর্য্য বর্ধন ও এর সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। এ ছাড়া দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতি ও চিন্তা-চেতনার অবাধ বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সদ্য স্বাধীন দেশের অবমূল্যায়ন নিরসনকল্পে বায়তুল মোকাররম সোসাইটি ও ইসলামিক একাডেমিকে একীভূত করে বৃহত্তর পরিসরে জাতীয় পর্যায়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যার কর্মকা- এখন সারাদেশের জেলায় জেলায় বিদ্যমান।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মসূচিগুলো
১। ইসলামিক মিশন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা: ইসলামের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে সেবাভিত্তিক বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিচালনা, যেমন বিনামূল্যে চিকিৎসা, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র জনগণকে হালাল রিজিক উপার্জনের জন্য সহায়তা দান ইত্যাদি।
২। মক্তব শিক্ষক প্রশিক্ষণ; মুবাল্লিগ প্রশিক্ষণ, এর মাধ্য সর্বসাধারনের মাঝে পবিত্র কুরআনের বিশুদ্ধ পাঠ শিক্ষা, ইবতেদায়ী মাদ্রাসা পরিচালনা ইত্যাদি।
৩। ইসলামিক ফাউন্ডেশন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা; এখানে সব ধরনের ইসলামি বই ও কুরআন-হাদিস পাওয়া যায়।
৪। যাকাত বোর্ড গঠন; মুসলিম দুঃস্থ মানবতার সেবায় এ প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত।
৫। ইসলামি প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রতিষ্ঠায় এর কার্যক্রম ব্যাপক।
৬। মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়ন।
৮। মসজিদভিত্তিক ইসলামি পাঠাগার স্থাপন।
৯। ক্যাসেট তৈরি কর্মসূচি গ্রহণ, এর মাধ্যমে কুরআন তেলাওয়াত ও ইসলামিক ওয়াজ, তাফসির ইত্যাদি ক্যাসেটের মাধ্যমে সম্প্রচার করা।
১০। ফাউন্ডেশন পুরস্কার।
১১। গবেষণা বিভাগ প্রতিষ্ঠা, কোরআন ও হাদিসের অনুবাদ তাফসির ও গবেষণা পরিচালনা।
১২। অনুবাদ ও সংকলন বিভাগ প্রতিষ্ঠা।
১৩। ইসলামি বিশ্বকোষ সংকলন ও প্রকাশ এবং বিতরণ করা।
১৪। ইসলামি প্রকাশনা বিভাগ-
১৫। বঙ্গবন্ধুর ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত হয়ে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড পুনর্গঠন করেন।
ইতিমধ্যে আমরা আলোচনা করেছি, ব্যক্তিজীবনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন খাঁটি ইমানদার মুসলিম। তিনি বাংলাদেশে ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। উক্ত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড গঠন। এর ফলে গোটা দেশের ছাত্রসমাজ অদ্যাবধি ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ইসলামি আকিদাভিত্তিক জীবন যাপন করতে পারছে এবং মেধাবী আলেমগণ শিক্ষকতা ও ইসলাম প্রচার করছেন। আমরা বঙ্গবন্ধুর এহেন মহান কাজের জন্য দোয়া প্রার্থনা করি।
ইসলাম প্রচারে তাবলীগ
বঙ্গবন্ধু ইসলামের শান্তিধারাকে সারা বিশ্বে পৌঁছে দেয়ার জন্য বাংলাদেশে তাবলীগ জামায়াতের বিশ্ব ইজতেমার সুব্যবস্থাপনায় টঙ্গিতে বিশাল আকারের মাঠসহ জমি বরাদ্দ দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। পবিত্র হজের পর সারা বিশ্বের মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এখানে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু স্বয়ং হেলিকপ্টার যোগে সেই টঙ্গী ইজতেমার ব্যবস্থাপনা ও সমাবেশ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকেও ইজতেমার মুনাজাতে অংশগ্রহণ করতে দেখেছি।
বঙ্গবন্ধুর আরো অনেক ইসলামি কর্মকাণ্ড রয়েছে, সবগুলো লিখে শেষ করা যাবে না। তিনি বেতার ও টেলিভিশনে কুরআন তিলাওয়াত ও প্রচারের ব্যবস্থা করে গেছেন। বাংলাদেশকে তিনি ওআইসির অন্তর্ভুক্ত করেন এবং তিনি ১৯৭৪ সালে ওআইসির সম্মেলনে যোগ দেন।এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু দেশ থেকে অন্যায়, অত্যাচার ব্যভিচার, মদ ও জুয়া নিষিদ্ধ করেন। ফলে দেশের মানুষ শান্তিতে ও নির্বিবাদে ধর্মকর্ম করে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারছেন।সর্বশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যুগান্তকারী অবদানের কথা বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।