বাঁধ ভেঙ্গে গেলে স্রোত আটকানো কঠিন। কথাটা শুনে হয়তো একটু কঠিনই মনে হবে এটা আবার কী বাঁধ আর কি স্রোত। কথাটার সারমর্ম আছে। বলছি সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাস নিয়ে। আপনারা জানেন পুরো পৃথিবী ওলটপালট করে দিচ্ছে মহামারী করোনা ভাইরাস। প্রতিদিনই এই ভাইরাস প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে হাজার হাজার মানুষের। এই ভাইরাসের এখনও কোন প্রতিষেধক আবিস্কার না হলেও এখনও আক্রান্তের চেয়ে মৃত্যুহার অনেক কম। দুই শতাধীক দেশে এখন পর্যন্ত হানা দিলেও প্রতিটা দেশই লড়াই করছে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ সরকারও বসে নেই। সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপ নিশ্চয়ই প্রশংসনীয়।
এরই মধ্যে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সরকার কার্যত গত ২৭ মার্চ থেকে দেশ লক ডাউনের মধ্যে রেখেছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার সারাদেশ লক ডাউনের ঘোষণা দেয়নি। তবুও যেহেতু জল, স্থল, আকাশ পথ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন শিল্প ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ ঘোষণা করেছে সেহেতু কার্যত লক ডাউন বলা যেতে পারে। এছাড়া, স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন জেলায় প্রশাসকরা সংশ্লিষ্ট জেলাগুলো সাময়িক লক ডাউন ঘোষণা করেছে। এছাড়া, কোথাও কোথাও, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড বা নির্দিষ্ট কয়েকটা বাড়ি ঘর লক ডাউন করা হয়েছে। যাতে করোনা ভাইরাস সামাজিকভাবে ব্যাপক বিস্তার করতে না পারে। সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই এবং অভিনন্দনও দিতে পারি। কিন্তু ভাল কিছু করলেও এর সঙ্গে খারাপ কিছুও জড়িত থাকে। এই খারাপটুকু জানতে হলে এবার আমরা একটু পিছনের দিকে যেতে পারি। অর্থাৎ গত বছর(২০২৯) ডিসেম্বর মাস।
বিশ্বের এই প্রজন্মের কাছে একটা স্মরণীয় মাস এবং বছর। আজকের করোনা ভাইরাস উৎপত্তি হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে। সেখানে ব্যপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে বিস্তার লাভ করেছে বিশ্বে। এখনও বিশ্বব্যাপী এই করোনা ভাইরাস (বিজ্ঞানীদের দেওয়া নাম হলো কভিড-১৯) ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। যখন চীনে এই ভাইরাসের উৎপত্তি হল এবং মিডিয়ার কল্যাণে হাসপাতালগুলোতে লাশের সারি দেখতে পেল বিশ্ববাসী তখনই তিন শতাধীক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে উহান থেকে বিমানে ফেরত আনলো বাংলাদেশ। রাখা হল হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টিনে। দুই সপ্তাহ পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হল। যাই হোক আমি কেন লেখার শিরোনাম দিলাম 'বাঁধ ভেঙ্গে গেলে স্রোত আটকানো কঠিন' সেই আলোচনা শুরু করি। করোনা ভাইরাসকে যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারী ঘোষণা দিল তখনও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীরা আসা শুরু করলো দেশে।
পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের নাগরিকরাও তাদের প্রয়োজনে আসলো বাংলাদেশে। ভারতেও আসা যাওয়া বন্ধ হয়নি উভয় দেশের নাগরিকদের। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কড়া বার্তার পরও বাংলাদেশ সরকার বন্দরগুলোর ইমিগ্রেশনে প্রাথমিকভাবে করোনা শনাক্তকরান স্ক্যানার ছিল না। শুধু হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটা স্ক্যানার মেশিন চালু ছিল। পরে মিডিয়া লেখালেখির পর স্ক্যানার বাড়ানো হয়। চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে চালু করা হয়। এরপরও দেশের বিভিন্ন বন্দরে ইমিগ্রেশনগুলোতে স্ক্যানার মেশিন বসানো হয়নি বা বসালেও অনেক দেরি হয়েছে। আমি গত ২৮ ফেব্রুয়ারী কলকাতায় গেলাম বাই ট্রেনে। ২ দিন পর বাই রোডে দেশে আসলাম বেনাপোল হয়ে। বেনাপোল বন্দরেও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়নি। চোখে পড়েনি কোন স্ক্যানার মেশিন। এ নিয়ে পত্রিকায় সরেজমিন প্রতিবেদনও করেছি আমি। কথা হল, করোনা ভাইরাস নিয়ে সরকার কঠোর অবস্থানে যখন থেকে সামাজিকভাবে এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। নিয়ন্ত্রণ কীভাবে করবে। ওই যে বললাম বাঁধ ভেঙ্গে গেলে স্রোত আটকানো কঠিন। বাঁধতো প্রথমেই ভেঙ্গেছে এখন স্রোত আটকাবে কীভাবে? যা হওয়ার হয়ে গেছে।
ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। আগে থেকে যদি কঠোর অবস্থানে থাকতো তাহলে হয়তো সম্ভব হতো। যেমনটা হয়েছে উত্তর কোরিয়ায়। যেহেতু ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। তাই দেশটিতে বাইরের দেশ থেকে কাউকেই প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এজন্যই উত্তর কোরিয়া সংক্রমণ মুক্ত। আমাদের দেশেও যদি প্রথম থেকে এমন কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হতো তাহলে হয়তোবা আজকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতে না। তখন আমাদের দেশের অনেক মন্ত্রীদের অতিকথনে নাগরিকরা অতিষ্ঠ হয়েছে। অন্তত বিমানবন্দরে যদি কড়াপদক্ষেপ নেওয়া হত তাহলেও এদেশ কিছুটা রক্ষা পেত। আচ্ছা বলুনতো দেখি,
যারা বিভিন্ন সংক্রামক দেশ থেকে বিমানবন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করেছে প্রশাসন কঠোর হলে কি তারা বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে যেতে হতোনা। প্রবাসীদেরতো আর মেরে ফেলতোনা। বিমানবন্দর থেকে তারা সাহসও পেতোনা বের হওয়ার। যদি আগে থেকে ঘোষণা দেওয়া হত তাদের দুই সপ্তাহের জন্য বাধ্যতামুলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে যেতে হবে। আমি মনে করি এখানে সরকারের বড় ধরনের গাফিলতি রয়েছে। আর এটা একরকম ব্যর্থতাও বলা যেতে পারে। এজন্যই বলেছি বাঁধ ভেঙ্গে গেলে স্রোত আটকানো কঠিন। বাঁধতো তখনই ভেঙ্গেছে যখনই সংক্রমক দেশ থেকে অবাধে প্রবাসীরা দেশে ঢুকেছে।
তখন অনেকের শরীরে নরমাল জ্বর থাকলেও বিমানে উঠে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাওয়াতে ইমিগ্রেশনে জ্বর ধরা পড়েনি। কিন্তু জ্বর থাকুক আর না থাকুক বাধ্যতামুলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে তাদের রাখা হলে বাংলাদেশ এই ঝুঁকির মধ্যে পড়তোনা। এখন যেহেতু ছড়িয়ে পড়েছে সেহেতু নিয়ন্ত্রণে কতটুকু আনতে পারে সেটাই দেখার বিষয়। তবুও এখন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। তিনি সরাসরি অনেক কিছু মনিটরিং করেন। কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তার জন্যও প্রাণপণ চেষ্টা করছেন তিনি। তবে এখনও সময় আছে অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য পুরোদেশে কারফিউ জারি করা দরকার। তাহলে হয়তো কিছুটা আশার আলো দেখা যেতে পারে। না হয় যেভাবে পাড়া, মহল্লা, অলিগলি, হাট-বাজারে মানুষের এখনও জটলা আর অবাধ চলাফেরা এভাবে করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।