ই-বর্জ্য থেকে অলিম্পিকের মেডেল

নিজস্ব প্রতিবেদক
সামির আসাফ, প্রতিনিধি ( ঢাকা )
প্রকাশিত: সোমবার ১৬ই আগস্ট ২০২১ ০৪:১১ অপরাহ্ন
ই-বর্জ্য থেকে অলিম্পিকের মেডেল

এ যেনো সুকুমার রায়ের “আবোল তাবোল” এর গল্প। ছিলো কাক, হয়ে গেলো বিড়াল। ছিলো ই-বর্জ্য, হয়ে গেলো অলিম্পিকের মেডেল।প্রাচীন গ্রীসে অলিম্পিক গেমস যখন শুরু হয়েছিল তখন বিজয়ীদের মাথায় পরিয়ে দেওয়া হতো জলপাই গাছের পাতা আর কাণ্ডে নির্মিত জয়মাল্য। এই জয়মাল্য ছিল বীরত্বের প্রতীক।


১৮৯৬ সালে যখন আধুনিক অলিম্পিক শুরু হয় তখন বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদেরকে পদক দেওয়ার নিয়ম চালু করা হয়। তবে তখন প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া ব্যক্তিকে রৌপ্য আর রানার্স-আপ প্রতিযোগীকে দেওয়া হতো তামার পদক। ১৯০৪ সালের অলিম্পিক গেমস থেকে কোনো প্রতিযোগীতায় প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হওয়া প্রতিযোগীদের যথাক্রমে স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জের পদক দেওয়ার নিয়ম চালু করা হয়।


বর্তমানে একেকটি অলিম্পিক স্বর্ণপদকে থাকে ৫৫০ গ্রাম রৌপ্য আর ছয় গ্রাম স্বর্ণ। রৌপ্যপদকে থেকে ৫০৯ গ্রাম রৌপ্য এবং ৪১ গ্রাম তামা দিয়ে। সর্বশেষ, ব্রোঞ্জ পদক বানানো হয়ে থাকে তামা, টিন আর দস্তা বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে।২০২১ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক এবং প্যারাঅলিম্পিক ২০২০-এ অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীদের গলায় জয়মাল্য প্রদানের লক্ষ্যে জাপানের অলিম্পিক গেমস আয়োজন কমিটি তৈরি করেছে সর্বমোট পাঁচ হাজার স্বর্ণ, রৌপ্য আর ব্রোঞ্জ পদক।


কিন্তু এই পদকগুলো সরাসরি নিরেট স্বর্ণ থেকে তৈরি হয়নি। বিজয়ীদের গলায় ঝুলবে এমন প্রতিটি পদকই বানানো হয়েছে ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য থেকে। হিটাচি, সনি, মিতসুবিশি আর প্যানাসনিক ইত্যাদি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের আঁতুড়ঘর জাপানের অন্যতম প্রধান সমস্যা ই-বর্জ্য। আর ই-বর্জ্যের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে দেশের জনসাধারণের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে তাদের অপ্রয়োজনীয় ই-বর্জ্য।


ইলেকট্রনিক বর্জ্যের ভেতর, হোক সেটি মোবাইল, কম্পিউটার কিংবা ছোটোখাটো ক্যালকুলেটর, এদের প্রতিটিতেই থাকে খুব অল্প পরিমাণ স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা, টিন, দস্তার মতো ধাতু। তৈরির সময়ই এই ধাতুগুলো থাকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রের অভ্যন্তরে। জাপান যেহেতু খনিজ সম্পদে অপ্রতুল তাই জনগণের হাতে জমা থাকা বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রনিক বর্জ্য সংগ্রহ করে সেখান থেকে মূল্যবান ধাতু সংগ্রহ করে অলিম্পিকের পদক বানানোর পদক্ষেপ নেয় অলিম্পিক আয়োজকরা।


পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহরের অন্যতম প্রধান সমস্যা ইলেকট্রনিক বর্জ্য। প্রতিদিন নতুন ইলেকট্রনিক পণ্য বাজারে আসার সাথে সাথে গ্রাহকরা পরিত্যাগ করছে পুরোনো পণ্যটি। তৈরি হচ্ছে ইলেকট্রনিক পণ্যের বিশাল জঞ্জাল। এই জঞ্জালের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মূল্যবান ধাতুর খনিকে অনেক বিশ্লেষক তাই ‘আরবান মাইন’ বা ‘শহুরে খনি’ নামে অভিহিত করে থাকেন।


তবে এই ই-বর্জ্যে মূল্যবান ধাতুর পাশাপাশি ভারী ধাতুর মতো বিষাক্ত পদার্থও থাকে। ঠিকভাবে এদেরকে আলাদা করতে না পারলে এরা খাদ্যশৃংখলে ঢুকে যেতে পারে এবং ঘটাতে পারে মারাত্মক বিপর্যয়।২০১৬ সাল নাগাদ পৃথিবীজুড়ে জমা হয়েছে প্রায় ৪৪.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন ই-বর্জ্য। প্রতি বছর এই বর্জ্যের পরিমাণ ৩-৪ শতাংশ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বর্জ্যের তালিকায় পুরোনো মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে ফ্রিজ, টেলিভিশন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, কম্পিউটার সবই আছে। তাই পৃথিবীর স্বার্থে এদেরকে পুনরায় ব্যবহারের বিকল্প নেই।


জাপানে ই-বর্জ্যকে কাজে লাগিয়ে অলিম্পিকের পদক তৈরির ব্যাপারটি আসলেই অসাধারণ। আর এই কাজে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে টোকিও অলিম্পিকের আয়োজক কমিটি দেশব্যাপী জনগণকে তাদের ঘরে পড়ে থাকা অপ্রয়োজনীয় ই-বর্জ্য জমা দিতে আহ্বান করে।ঘোষণার পর পরই জমা পড়া ই-বর্জ্য থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ৩০.৩ কেজি স্বর্ণ। রৌপ্য উদঘাটিত হয়েছে ৪১০০ কেজি আর ব্রোঞ্জ সংগ্রহ করা হয়েছে ২৭০০ কেজি যা লক্ষ্যমাত্রার পুরোটাই পূরণ করেছে। আর এই বিশাল কর্মযজ্ঞে ব্যবহার করা হয়েছে ৭৮,৯৮৫ টন ই-বর্জ্য।


এর পাশাপাশি এবারের অলিম্পিক আসরের ১০০টি পোডিয়াম তৈরি হয়েছে গৃহস্থালির অব্যবহৃত প্রায় ৪৫ টন প্লাস্টিকের বর্জ্য থেকে।অলিম্পিক কমিটি আশা করছে এইবারের আসরে যেহেতু সফলভাবে ই-বর্জ্য থেকে ধাতু সংগ্রহ করা গেছে পরবর্তী অলিম্পিক গুলোতেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। এতে করে যেমন প্রয়োজনীয় ধাতু সংগ্রহ করা যাবে, সেই সংগে মুক্তি পাওয়া যাবে বর্তমান সময়ের বৈশ্বিক সমস্যা ই-বর্জ্য থেকেও।