জুম্মার দিনের আমল, ফজিলত ও গুরুত্ব

নিজস্ব প্রতিবেদক
ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: শুক্রবার ৯ই সেপ্টেম্বর ২০২২ ১১:২৩ পূর্বাহ্ন
জুম্মার দিনের আমল, ফজিলত ও গুরুত্ব

১. সূর্য উদিত হয় এমন দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন হলো সর্বোত্তম। হাদিসের ভাষ্য মতে, এদিনে বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। যথা-


(ক) এ দিনে আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয়।

(খ) এ দিনেই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়।

(গ) একই দিনে তাকে জান্নাত থেকে বের করে দেয়া হয়। (মুসলিম : ৮৫৪)।

(ঘ) একই দিনে তাকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়।

(ঙ) এ দিনেই তার তওবা কবুল করা হয়।

(চ) এ দিনেই তার রূহ কবজ করা হয়। (আবু দাউদ : ১০৪৬)।

(ছ) এ দিনে শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে।

(জ) এ দিনেই কেয়ামত হবে।

(ঝ) এ দিনেই সবাই বেহুঁশ হয়ে যাবে। (আবু দাউদ : ১০৪৭)।

(ঞ) প্রত্যেক নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা, আকাশ, পৃথিবী, বাতাস, পর্বত ও সমুদ্র এ দিনটিকে ভয় করে। (ইবনে মাজাহ : ১০৮৪)।


২. উম্মতে মুহাম্মদির জন্য এটি একটি মহান দিন। এ জুমার দিনটিকে সম্মান করার জন্য ইহুদি-নাসারাদের ওপর নির্দেশ দেয়া হয়েছিল; কিন্তু তারা মতবিরোধ করে এ দিনটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। অতঃপর ইহুদিরা শনিবারকে আর খ্রিস্টানরা রোববারকে তাদের ইবাদতের দিন বানিয়েছিল।

অবশেষে আল্লাহ তায়ালা এ উম্মতের জন্য শুক্রবারকে মহান দিবস ও ফজিলতের দিন হিসেবে দান করেছেন। আর উম্মতে মুহাম্মদি তা গ্রহণ করে নিয়েছে। (বোখারি : ৮৭৬)।


৩. জুমার দিন হলো সাপ্তাহিক ঈদের দিন। (ইবনে মাজাহ : ১০৯৮)।


৪. জুমার দিনটি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনের চেয়েও শ্রেষ্ঠ দিন। এ দিনটি আল্লাহর কাছে অতি মর্যাদাসম্পন্ন। (ইবনে মাজাহ : ১০৮৪)।


৫. জুমার দিনে এমন একটি সময় আছে, যখন বান্দা আল্লাহর কাছে যা চায়, তাই তাকে দেয়া হয়। (এ সময়টি গোপন রাখা হয়েছে-তবে এক হাদীস অনুযায়ী) এ সময়টি হলো জুমার দিন আসরের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত। (মুসলিম : ৮৫২)।


৬. জুমার রাতে বা দিনে যে ব্যক্তি মারা যায় আল্লাহ তায়ালা তাকে কবরের ফেতনা থেকে রক্ষা করবেন। (তিরমিজি : ১০৭৮)


৭. জান্নাতে প্রতি জুমার দিনে জান্নাতিদের হাট বসবে। জান্নাতি লোকেরা সেখানে প্রতি সপ্তাহে একত্রিত হবেন। তখন সেখানে এমন মনোমুগ্ধকর হাওয়া বইবে, যে হাওয়ায় জান্নাতিদের সৌন্দর্য অনেকগুণে বেড়ে যাবে এবং তাদের স্ত্রীরাতা দেখে অভিভূত হবে। অনুরূপ সৌন্দর্য বৃদ্ধি স্ত্রীদের বেলায়ও হবে। (মুসলিম :২৮৩৩)


৮. যে ব্যক্তি জুমার দিনে সূরা কাহফ পড়বে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য দুই জুমারমধ্যবর্তী সময়কে আলোকিত করে দেবেন। (জামেউস সাগির : ৬৪৭০)।


৯. যে ব্যক্তি জুমার দিনে সূরা কাহফের প্রথম ১০ আয়াত পড়বে, সে দাজ্জালের ফেতনা থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে। (মুসলিম)।


১০. প্রত্যেক সপ্তাহে জুমার দিন আল্লাহ তায়ালা বেহেশতি বান্দাদের দর্শন দেবেন।(সহিহুত তারগিব)।


১১. এই দিনে দান-খয়রাত করার সওয়াব অন্য দিনের চেয়ে বেশি হয়। ইবনুল কায়্যিম বলেছেন, অন্য মাসের তুলনায় রমজান মাসের দানের সওয়াব যেমন বেশি, তেমনি শুক্রবারের দান-খয়রাত অন্য দিনের তুলনায় বেশি। (জাদুল মায়াদ)।


১২. ইবনুল কায়্যিম আরও বলেছেন, অন্য মাসের তুলনায় রমজান মাসের মর্যাদা যেমন,সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তুলনায় জুমা বারের মর্যাদা ঠিক তেমন। তাছাড়া রমজানের কদরের রাতে যেমনভাবে দোয়া কবুলহয়, ঠিক তেমনি শুক্রবারের সূর্যাস্তের পূর্বক্ষণেও দোয়া কবুল হয়। (জাদুল মায়াদ : ১/৩৯৮)।


১৩. হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি জুম্মার দিন সূরা কাহফ পড়বে তার দুই জুম্মার মধ্যবর্তী সমগ্র সময় জুড়ে তার ওপর আল্লাহর জ্যোতি বর্ষিত হতে থাকবে”। [নাসায়ী, বাইহাকী]


জুমুআর দিনে গুরুত্বপূর্ণ পালনীয় সুন্নাত ও আদবসহ ৩৮ টি পয়েন্ট দেয়া হলোঃ১) জুম’আর দিন গোসল করা। যাদের উপর জুম’আ ফরজ তাদের জন্য এ দিনে গোসল করাকে রাসুল(সাঃ) ওয়াজিব করেছেন(বুখারীঃ ৮৭৭, ৮৭৮, ৮৮০, ৮৯৭,৮৯৮)। পরিচ্ছন্নতার অংশ হিসাবে সেদিন নখ ও চুল কাটা একটি ভাল কাজ।

২) জুম’আর সালাতের জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করা। (বুখারীঃ ৮৮০)

৩) মিস্ওয়াক করা। (ইবনে মাজাহঃ ১০৯৮, বুখারীঃ৮৮৭,ইঃফাঃ৮৪৩)

৪) গায়ে তেল ব্যবহার করা। (বুখারীঃ৮৮৩)

৫) উত্তম পোশাক পরিধান করে জুম’আ আদায় করা।(ইবনে মাজাহঃ১০৯৭)

৬) মুসুল্লীদের ইমামের দিকে মুখ করে বসা। (তিরমিযীঃ ৫০৯, ইবনে মাজাহঃ১১৩৬)

৭) মনোযোগ সহ খুৎবা শোনা ও চুপ থাকা- এটা

ওয়াজিব। (বুখারীঃ ৯৩৪, মুসলিমঃ৮৫৭, আবু দাউদঃ১১১৩,আহমাদঃ১/২৩০)

৮) আগে ভাগে মসজিদে যাওয়া। (বুখারীঃ৮৮১,মুসলিমঃ৮৫০)

৯) পায়ে হেঁটে মসজিদে গমন। (আবু দাউদঃ ৩৪৫)

১০) জুম’আর দিন ফজরের নামাজে ১ম রাক’আতে সূরা

সাজদা (সূরা নং-৩২) আর ২য় রাকা’আতে সূরা ইনসান(দাহর)(সূরা নং-৭৬) পড়া। (বুখারীঃ৮৯১, মুসলিমঃ৮৭৯)

১১) সূরা জুম’আ ও সূরা মুনাফিকুন দিয়ে জুম’আর সালাত আদায় করা। অথবা সূরা আলা ও সূরা গাশিয়া দিয়ে জুম’আ আদায় করা। (মুসলিমঃ৮৭৭, ৮৭৮)

১২) জুম’আর দিন ও জুম’আর রাতে বেশী বেশী দুরুদ পাঠ। (আবু দাউদঃ ১০৪৭)

১৩) এ দিন বেশী বেশী দোয়া করা।(বুখারীঃ৯৩৫)

১৪) মুসুল্লীদের ফাঁক করে মসজিদে সামনের দিকে এগিয়ে না যাওয়া। (বুখারীঃ৯১০, ৮৮৩)

১৫) মুসুল্লীদের ঘাড় ডিঙ্গিয়ে সামনের কাতারে আগানোর চেষ্টা না করা। (আবু দাউদঃ ৩৪৩, ৩৪৭)

১৬) কাউকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে বসার চেষ্টা না করা। (বুখারীঃ৯১১, মুসলিমঃ২১৭৭, ২১৭৮)

১৭) খুৎবা চলাকালীন সময়ে মসজিদে প্রবেশ করলে তখনও দু’রাকা’আত ‘তাহিয়্যাতুল মাসজিদ’ সালাত আদায় করা ছাড়া না বসা। (বুখারীঃ ৯৩০)

১৮) জুম’আর দিন জুম’আর পূর্বে মসজিদে জিকর বা কোন শিক্ষামুলক হালকা না করা। অর্থাৎ ভাগ ভাগ হয়ে,গোল গোল হয়ে না বসা, যদিও এটা কোন

শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান হোক না কেন। (আবু দাউদঃ১০৮৯)

১৯) কেউ কথা বললে ‘চুপ করুন’ এটুকুও না বলা।(নাসায়ীঃ ৭১৪, বুখারীঃ ৯৩৪)

২০) মসজিদে যাওয়ার আগে কাঁচা পেয়াজ, রসুন না খাওয়া ও ধুমপান না করা। (বুখারীঃ ৮৫৩)

২১) ঘুমের ভাব বা তন্দ্রাচ্ছন্ন হলে বসার জায়গা বদল করে বসা। (আবু দাউদঃ ১১১৯)

২২) ইমামের খুৎবা দেওয়া অবস্থায় দুই হাঁটু উঠিয়ে না বসা। (আবু দাউদঃ ১১১০, ইবনে মাজাহঃ ১১৩৪)

২৩) খুৎবার সময় ইমামের কাছাকাছি বসা। জান্নাতে প্রবেশের উপযুক্ত হলেও ইমাম থেকে দূরে উপবেশন কারীরা বিলম্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (আবু দাউদঃ ১১০৮)

২৪) জুম’আর দিন সূরা কাহফ পড়া। এতে পাঠকের জন্য আল্লাহ তায়ালা দুই জুম’আর মধ্যবর্তী সময়কে আলোকিত করে দেন। (হাকেমঃ ২/৩৬৮, বায়হাকীঃ৩/২৪৯)

২৫) জুম’আর আযান দেওয়া। অর্থাৎ ইমাম মিম্বরে বসার পর যে আযান দেওয়া হয় তা।(বুখারীঃ ৯১২)

২৬) জুম’আর ফরজ নামাজ আদায়ের পর মসজিদে ৪ রাকা’আত সুন্নাত সালাত আদায় করা। (বুখারীঃ ১৮২, মুসলিমঃ৮৮১, আবু দাউদঃ ১১৩০)

২৭) উযর ছাড়া একই গ্রাম ও মহল্লায় একাধিক জুম’আ চালু না করা। আর উযর হল এলাকাটি খুব বড় হওয়া, বা প্রচুর জনবসতি থাকা, বা মসজিদ দূরে হওয়া, বা মসজিদে জায়গা না পাওয়া, বা কোন ফিতনা ফাসাদের ভয় থাকা। (মুগনি লিবনি কুদামাঃ ৩/২১২, ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহঃ ২৪/২০৮)

২৮) ওজু ভেঙ্গে গেলে মসজিদ থেকে বের হয়ে যাওয়া। অতঃপর আবার ওজু করে মসজিদে প্রবেশ করা। (আবু দাউদঃ ১১১৪)

২৯) একান্ত উযর না থাকলে দুই পিলারে মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় সালাত আদায় না করা। (হাকেমঃ ১/১২৮)

৩০) সালাতের জন্য কোন একটা জায়গাকে নির্দিষ্ট করে না রাখা, যেখানে যখন জায়গা পাওয়া যায় সেখানেই সালাত আদায় করা (আবু দাউদঃ৮৬২)। অর্থাৎ

আগে থেকেই নামাজের বিছানা বিছিয়ে জায়গা দখল করে না রাখা বরং যে আগে আসবে সেই আগে বসবে।

৩১) কোন নামাজীর সামনে দিয়ে না হাঁটা অর্থাৎ মুসুল্লী ও সুতরার মধ্যবর্তী জায়গা দিয়ে না হাঁটা। (বুখারীঃ৫১০)

৩২) এতটুকু জোরে আওয়াজ করে কোন কিছু না পড়া, যাতে অন্যের সালাত ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে। (আবু দাউদঃ ১৩৩২)

৩৩) পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়ার ফযীলত অন্তরে জাগরূক রাখা।

৩৪) হাঁটার আদব মেনে মসজিদে গমন করা।

৩৫) খুৎবার সময় খতীবের কোন কথার সাড়া দেওয়া বা তার প্রশ্নের জবাব দানে শরীক হওয়া জায়েজ।(বুখারীঃ ১০২৯, মুসলিমঃ ৮৯৭)

৩৬) হানাফী আলেমগন বলেছেন যে, ভিড় প্রচণ্ড হলে সামনের মুসুল্লীর পিঠের উপর

সিজদা দেওয়া জায়েজ (আহমাদঃ১/৩২)। দরকার হলে পায়ের উপর ও দিতে পারে (আর রাউদুল মুরবী)

৩৭) যেখানে জুম’আর ফরজ আদায় করেছে, উত্তম হল ঐ একই স্থানে সুন্নাত না পড়া। অথবা কোন কথা না বলে এখান থেকে গিয়ে পরবর্তী সুন্নাত সালাত আদায় করা। (মুসলিমঃ ৭১০, বুখারীঃ ৮৪৮)

৩৮) ইমাম সাহেব মিম্বরে এসে হাজির হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাসবীহ-তাহলীল, তাওবা- ইস্তিগফার ও কুরআন তিলাওয়াতে রত থাকা।

লেখকঃ অধ্যাপক মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম

সূত্রঃ বই-প্রশ্নোত্তরে জুমু’আ ও খুৎবা

পরিমার্জনেঃ ডঃ মোহাম্মদ মনজুরে ইলাহী,

ডঃ আবু বকর মুহাম্মদ জাকারিয়া মজুমদার,

ডঃ মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ।


জুমুআর দিনে ও রাতে বেশী বেশী দরুদ পাঠ করার ফজিলত!!!


জুমআর রাতে (বৃহ্‌স্পতিবার দিবাগত রাতে) ও (জুমআর) দিনে প্রিয়তম হাবীব মহানবী (সাঃ)-এর শানে অধিকাধিক দরুদ পাঠ করা কর্তব্য। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হল, জুমআর দিন। এই দিনে তোমরা আমার প্রতি দরুদ পাঠ কর। যেহেতু তোমাদের দরুদ আমার উপর পেশ করা হয়ে থাকে। (আবূদাঊদ, সুনান ১৫৩১নং)


তিনি আরো বলেন, “জুমআর রাতে ও দিনে তোমরা আমার উপর বেশী বেশী দরুদ পাঠ কর। আর যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করবে, সে ব্যক্তির উপর আল্লাহ ১০ বার রহ্‌মত বর্ষণ করবেন।” (বায়হাকী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৪০৭নং


জুমুআর নামাজের আগে ও পরে কত রাকাত সুন্নাত নামাজ পড়তে হবে? জুমুআর_আগের_সুন্নাতঃ জুমআর খুতবার পূর্বে ‘কাবলাল জুমুআহ’ বলে কোন নির্দিষ্ট রাকআত সুন্নত নেই। অতএব নামাযী মসজিদে এলে ‘তাহিয়্যাতুল মাসজিদ’ ২ রাকআত সুন্নত পড়ে বসে যেতে পারে এবং দুআ, দরুদ তাসবীহ- যিকর বা তেলাওয়াত করতে পারে।