ইসলামে মানুষের সম্মান ও অধিকার

নিজস্ব প্রতিবেদক
ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৯:০৩ পূর্বাহ্ন
ইসলামে মানুষের সম্মান ও অধিকার

আল্লাহ মানবজাতিকে সম্মানিত করেছেন তার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার মাধ্যমে। শুধু জীবনকালে নয়; বরং মৃত্যুর পর তাকে মর্যাদার অধিকারী করেছেন। ইসলামী আইনজ্ঞরা ইসলামী শরিয়তের যে মৌলিক পাঁচটি উদ্দেশ্য নির্ণয় করেছেন, তার চারটিই মানুষের পার্থিব অধিকার, সম্মান ও মর্যাদাসংশ্লিষ্ট এবং সাধারণভাবে সব মানুষের জন্য প্রযোজ্য। তা হলো, দ্বিনের সংরক্ষণ, জীবনের সংরক্ষণ, সম্মানের সংরক্ষণ, সম্পদের সংরক্ষণ ও বংশধারার সংরক্ষণ।


(তাওদিউল আহকাম মিন বুলুগিল মারাম : ১/৪৪)

 

সব মানুষই সম্মানিত

মানবজাতির এই সম্মান ও মর্যাদা সর্বজনীন। প্রতিটি মানুষ সে বিশ্বাসী হোক বা অবিশ্বাসী মৌলিক সম্মান ও অধিকারের ক্ষেত্রে সমান। পবিত্র কোরআনের বর্ণনা থেকেও ‘সাধারণ সম্মান সব মানুষের জন্য’ প্রমাণিত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানবজাতিকে সম্মানিত করেছি, তাকে কর্তৃত্ব দিয়েছি স্থলে ও জলে, তাদেরকে দিয়েছি উত্তম জীবিকা এবং তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি আমার সৃষ্টিজগতের অনেকের ওপর। ’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৭০)


রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মানুষকে সম্মান দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পাশ দিয়ে একটি লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁকে বলা হলো, লাশটি একজন ইহুদির। রাসুল (সা.) বললেন, সে কি মানুষ নয়?’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৯৬১)


মৌলিক অধিকারে সবাই সমান

মানুষের সম্মানসংক্রান্ত আয়াতে আল্লাহ যেমন বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর মধ্যে পার্থক্য করেননি, তেমন মৌলিক অধিকারসংক্রান্তkalerkantho আয়াতেও তা করা হয়নি। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ যাকে হত্যা করা নিষিদ্ধ করেছেন তাকে তোমরা আইনানুগ কারণ ছাড়া হত্যা কোরো না। ’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১৫১)


এসব আয়াতের ভিত্তিতে ইসলামী আইনবেত্তারা বলেন, ‘মানুষ সত্তাগতভাবে সম্মানী। সুতরাং তাকে অপমান করা, তার প্রতি অবিচার করা, তার অধিকার নষ্ট করা, সম্মানহানি করা অন্য কোনো মানুষের জন্য বৈধ নয়। সবার প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করা আবশ্যক। ’ (https://bit.ly/33WAeBO)


জীবনের অধিকার সবার

আল্লাহ মুসলমানের রক্ত ও সম্পদের বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। তবে নিরাপদ জীবন যাপন ও বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছেন সব মানুষকেই। পবিত্র কোরআনে একজন মানুষের জীবনকে সমগ্র মানবজাতির জীবনের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি মানুষ হত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর দায় ছাড়া কোনো মানুষকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। যে কোনো একজন মানুষের জীবন রক্ষা করল, সে যেন সব মানুষের জীবন রক্ষা করল। ’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৩২)


রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহর কাছে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার চেয়ে একজন মুসলিমের খুন হওয়া গুরুতর। ’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৩৯৫)


ভ্রূণ হত্যাও অপরাধ

মানুষের মতো মানব-ভ্রূণও ইসলামের দৃষ্টিতে সম্মানিত। ইসলাম শরিয়ত অনুমোদিত কারণ ছাড়া মানব-ভ্রূণ হত্যাকে নিষিদ্ধ করেছে। কেননা তা প্রকারান্তে মানব হত্যারই শামিল এবং মানব সত্তার প্রতি অসম্মান। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা অভাব-অনটনের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। ’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১৫১)


আত্মহত্যা মনুষ্যত্বের প্রতি অসম্মান

ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ ও জঘন্যতম পাপ। কেননা আত্মহত্যার মাধ্যমে মানুষ নিজের প্রতি এবং তার স্রষ্টার প্রতি অসম্মান ও অনাস্থা প্রকাশ করে। আল্লাহ তার প্রতি যে সীমাহীন অনুগ্রহ করেছেন তা অস্বীকারের নামান্তর আত্মহত্যা। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহশীল। কেউ সীমালঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা করলে আমি তাকে আগুনে পোড়াব। আর আল্লাহর জন্য তা সহজ। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ২৯-৩০)


মানুষকে ভয় দেখানো নিষিদ্ধ

রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে ভয় দেখাতে এবং শাসাতে নিষেধ করেছেন। কেননা তা মানুষের অধিকার ও মর্যাদার পরিপন্থী। তিনি বলেন, ‘কোনো মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমকে ভয় দেখানো বৈধ নয়। ’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৫০০৪)


অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) অন্যের প্রতি অস্ত্র তাক করতে বা অস্ত্র দিয়ে ইঙ্গিত করতে নিষেধ করেছেন।


মানুষ সাধারণভাবে ক্ষমাপ্রাপ্ত

ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ সাধারণভাবে ক্ষমাপ্রাপ্ত। ক্ষমা প্রদানের মাধ্যমে আল্লাহ মানবজাতিকে সম্মানিত করেছেন। তাই নিছক ধারণার বশে কাউকে অভিযুক্ত করা বা শাস্তি দেওয়া যাবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের সবাই ক্ষমাপ্রাপ্ত। কিন্তু অপরাধ প্রকাশকারীরা ছাড়া। ...’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৬৯)


নির্দোষ ও নিরপরাধ জীবন মানুষের অধিকার

নির্দোষ ও নিরপরাধ জীবনযাপন মানুষের অধিকার। কেউ তাকে ও তার সামাজিক অবস্থানকে কলুষিত করার অধিকার রাখে না। অন্যায়ভাবে মানুষের ওপর দোষ চাপানো এবং অন্যায় কাজে তাকে বাধ্য করা ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয় এমন কোনো অপরাধের জন্য যা তারা করেনি, সে অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করবে। ’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৫৮)


এমনকি সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকে দোষ স্বীকারে বাধ্য করাও ইসলামী দণ্ডবিধিতে নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মতের ভুল-ত্রুটি ও যে কাজে তাদের বাধ্য করা হয়েছে তা মার্জনা করেছেন। ’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২০৪৫)


মৃত্যুর পরও মানুষ সম্মানিত

জীবিত অবস্থায় মানুষ যেমন সম্মানিত, মৃত্যুর পরও সে সম্মানের যোগ্য। ইসলাম মানুষের আল্লাহ প্রদত্ত সম্মান রক্ষার জন্য মৃত্যুর পর তাকে সুন্দরভাবে কাফন-দাফনের নির্দেশ দিয়েছে। এবং এমন সব কাজ থেকে নিষেধ করেছে যাতে তার প্রতি অসম্মান প্রকাশ পায়। যেমন, মানুষের লাশের অঙ্গহানি ও বিকৃতি করা, পরিত্যক্ত অবস্থায় তা ফেলে রাখা বা ঘৃণাবশত তা আগুনে পোড়ানো ইত্যাদি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা যখন তোমাদের কোনো ভাইকে কাফন পরিধান করাও তখন সুন্দরভাবে পরিধান করাবে। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৯৪৩)


তিনি আরো বলেছেন, ‘তোমরা মৃতদের গালি দিয়ো না। কেননা তারা তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান পেয়ে গেছে। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৫১৬)


মানুষ দাস নয়

পৃথিবীর জীবন ও বাস্তবতার কারণে ইসলাম দাসপ্রথাকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেনি। তবে দাসপ্রথার প্রতি নিরুৎসাহ করেছে। নানা প্রতিকূলতার কারণে কেউ দাসত্বের শিকার হলেও তার সঙ্গে দাসসুলভ আচরণ করতে নিষেধ করেছে। বরং মানুষ হিসেবে তার সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করতে বলেছে। প্রকৃতপক্ষে মানুষ আল্লাহর দাস এবং মানুষের সেবক। এ জন্য ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলতেন, ‘তোমরা কখন মানুষকে দাস বানিয়ে ফেললে, অথচ তারা স্বাধীন হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছে। ’ (আল ইরহাবুদ-দুওয়ালি, পৃষ্ঠা ১৯৫)


মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব মানবিকতায়

মৌলিক অধিকার ও সম্মানে সব মানুষ সমান হলেও জ্ঞান, আল্লাহভীতি ও মানবিকতার দ্বারা মানুষ অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘বলুন! যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি কখনো সমান হতে পারে? ’ (সুরা জুমার, আয়াত : ৯)


রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী, সেই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। ’ (আততারগিব, হাদিস : ২৬২৩)