‘অভিযান-১০ কান্ডে সার্ভেয়ারসহ ১২ জন দায়ী’ করে তদন্ত প্রতিবেদন

নিজস্ব প্রতিবেদক
ইনিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: শনিবার ২২শে জানুয়ারী ২০২২ ০৬:৫৯ অপরাহ্ন
‘অভিযান-১০ কান্ডে সার্ভেয়ারসহ ১২ জন দায়ী’ করে তদন্ত প্রতিবেদন

‘এমভি অভিযান-১০’ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনায় লঞ্চটির ফিটনেস পরীক্ষাকারী শিপ সার্ভেয়ারসহ নৌ পরিবহন অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটি’র চার কর্মকর্তা এবং চার মালিকসহ মোট ১২ জনকে দায়ী করেছে নাগরিক তদন্ত কমিটি।


শনিবার (২২ জানুয়ারি) সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে নৌ দুর্ঘটনা রোধে ২৫ দফা সুপারিশসহ এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।


পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলন, নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি এবং সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনসহ ১৬টি সামাজিক সংগঠন গত ৪ জানুয়ারি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিদের নিয়ে ১৯ সদস্যের এই নাগরিক তদন্ত কমিটি গঠন করে; যা দেশে কোনো নৌ-দুর্ঘটনা পরবর্তী এটাই প্রথম।


প্রতিবেদনে দায়ীরা হলেন- নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের ঢাকা (সদরঘাট) কার্যালয়ের প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক মো. মাহবুবুর রশীদ ও পরিদর্শক মো. হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদীন ও পরিদর্শক দীনেশ দাস, লঞ্চটির চার মালিক মো. হামজালাল শেখ, মো. শামীম আহম্মেদ, মো. রাসেল আহাম্মেদ ও ফেরদৌস হাসান রাব্বি। এছাড়া প্রথম শ্রেণির মাস্টার মো. রিয়াজ সিকদার ও দ্বিতীয় শ্রেণির মাস্টার মো. খলিলুর রহমান এবং প্রথম শ্রেণির ড্রাইভার মো. মাসুম বিল্লাহ ও দ্বিতীয় শ্রেণির ড্রাইভার আবুল কালাম।


প্রতিবেদনে বলা হয়, অবকাঠামো ও কারিগরি বিষয়ে সার্বিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই চলাচলের যোগ্য মর্মে মতামত দেয়ায় এবং দীর্ঘদিন বন্ধের পর পুনরায় চলাচলের সময় লঞ্চটি পরীক্ষা না করায় নৌ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট জরিপকারক এবং যাত্রার প্রাক্কালে লঞ্চটি পরিদর্শন না করে ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ইঞ্জিন পরিবর্তনের বিষয়টি না জানিয়ে একই সংস্থার পরিদর্শক দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।


দীর্ঘদিন বন্ধের পর পুনরায় চালু হওয়া লঞ্চটিতে ইঞ্জিন পরিবর্তনের বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে এবং ২৩ ডিসেম্বর নৌযানটিকে সদরঘাট টার্মিনাল ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে বিআইডব্লিউটি’র নৌ নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম পরিচালক কর্তব্যে অবহেলা করেছেন। এছাড়া ৪২০ জন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন লঞ্চে আনুমানিক আট শতাধিক যাত্রী বহন করা সত্ত্বেও মাত্র ৩১০ জন উল্লেখ করা ভয়েজ ডিক্লারেশন গ্রহণ করে সদরঘাটে দায়িত্বরত বিআইডব্লিউটিএ’র পরিবহন পরিদর্শক দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।


নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া নৌযানটিতে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন দুটি ইঞ্জিন প্রতিস্থাপন এবং কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে নতুন মাস্টার ও ড্রাইভার নিয়োগ করে প্রচলিত আইন ও বিধি লঙ্ঘন করেছেন। ২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা ছেড়ে রাতে চাঁদপুর পৌঁছানোর পর ইঞ্জিনে কয়েকবার সমস্যা দেখা দিলেও মাস্টাররা তা আমলে না নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে চালিয়ে নিয়ে দুই মাস্টার গুরুতর অপরাধ করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।


এছাড়া বরিশাল থেকে ঝালকাঠি যাওয়ার পথে সুগন্ধা নদীতে লঞ্চটিতে অগ্নিকাণ্ডের মাত্রা বাড়তে থাকলে প্রথমবার এটি যেখানে ভেড়ানো হয়, আগুন নেভানোর চেষ্টা না করে ড্রাইভাররা কাউকে কিছু না বলে সেখানেই নেমে গিয়ে তারা চরম দায়িত্বহীন কাজ করেছেন।        


নাগরিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কমিটির আহ্বায়ক ও পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান। কমিটির সদস্য সচিব ও নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য সচিব আমিনুর রসুল বাবুলের সঞ্চালনায় তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক এবং নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে।


সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন নাগরিক কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য নৌ প্রকৌশলী মো. আব্দুল হামিদ ও সদস্য জাকির হোসেন। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নাগরিক তদন্ত কমিটির সদস্য ও মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রের মহাসচিব মাহবুল হক, নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি হাজী মোহাম্মদ শহীদ মিয়া, সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল ভদ্র, ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের (নাসাফ) মহাসচিব তৈয়ব আলী, পুরনো ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের আহ্বায়ক নাজিম উদ্দিন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নাগরিক ফোরামের যুগ্ম সম্পাদক মোস্তফা কামাল আকন্দ, পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান প্রমুখ।  


তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে নৌ দুর্ঘটনা রোধে ২৫টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো:


১. এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ ট্রাজেডির জন্য শুধু মালিক, মাস্টার ও ড্রাইভারের শাস্তি নয়; দায়ী সকলকেই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তা না হলে দায়িত্ব পালনে অবহেলার প্রবণতা দিন দিন বেড়ে যাবে এবং দুর্ঘটনাও কমবে না।


২. দুর্ঘটনায় নিহত পরিবার ও আহতদের ক্ষতিপূরণের আইন প্রণয়ন, টাকার পরিমাণ নির্ধারণ এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী (নৌযান মালিক/মাস্টার/ড্রাইভার/সরকারি কর্মকর্তা) ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করতে হবে।


৩. প্রত্যেক যাত্রীবাহী নৌযানে আনসার/সিকিউরিটি থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে।


৪. যাত্রীবাহী লঞ্চের ইঞ্জিনকক্ষ, প্রবেশপথ, মাস্টারব্রিজসহ স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিসি ক্যামেরা স্থাপন।


৫. যেকোনো নৌযানের নকসায় অগ্নি-নিরাপত্তার বিষয়টি যুক্ত, সে অনুযায়ী নকসা অনুমোদন এবং যথাযথভাবে নকসা অনুসরণ করে নৌযান নির্মাণ করতে হবে।


৬. নতুন নৌযানে অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা সঠিক আছে কি না, তা নিশ্চিত হতে ফায়ার সার্ভিস বিভাগের ছাড়পত্র গ্রহণ এবং ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক প্রতি তিন মাস পরপর তা পরীক্ষা করা।  


৭. চলমান নৌযানগুলো বিশেষ করে লঞ্চ ও অন্যান্য যাত্রীবাহী নৌযানের অগ্নি-প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে কি না, তা আগামী ছয় মাসের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পরীক্ষা করা।


৮. লঞ্চের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনে দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা যাবে না।


৯. ইঞ্জিনকক্ষের পাশ থেকে খাবারের হোটেল সরিয়ে নিতে হবে এবং ইঞ্জিনকক্ষ ও ক্যান্টিন (হোটেল) এর আশেপাশে জ্বালানি তেলসহ কোনো ধরনের দাহ্য পদার্থ রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা।  


১০. নৌযানের ইঞ্জিনকক্ষে আগুন লাগলে তা দ্রুত নেভানোর জন্য স্থায়ী কার্বন ডাই-অক্সাইড সরবরাহ ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা।


১১. নৌযানের সকল সকল কর্মীকে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র পরিচালনার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক ও বছরে অন্তত একবার মহড়ার ব্যবস্থা করা।


১২. প্রত্যেক নাবিকের ইউনিফর্ম পরিধান বাধ্যতামূলক করতে হবে।


১৩. আইএসও ৫৮(ক) ধারা মোতাবেক যাত্রীবাহী নৌযানের বীমা অথবা নৌ দুর্ঘটনা ট্রাস্ট ফান্ড বাধ্যতামূলক করতে হবে।


১৪. যেকোনো নৌদুর্ঘটনা সুষ্ঠু তদন্তের জন্য অভিজ্ঞ নৌস্থপতি, নৌপ্রকৌশলী, পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ, মাষ্টারমেরিনার, নৌ পরিবহনবিষয়ক গবেষক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, জ্যেষ্ঠ গণমাধ্যমকর্মী এবং নৌ মন্ত্রণালয়, নৌ অধিদপ্তর, নৌযানমালিক ও শ্রমিক সংগঠনের একজন করে প্রতিনিধির সমন্বয়ে জাতীয় তদন্ত কমিটি গঠন।  


১৫. প্রত্যেক দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা নৌ মন্ত্রণালয় ও নৌ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ।


১৬. আধুনিক ও ত্রুটিমুক্ত নৌযান নির্মাণের স্বার্থে নকসা অনুমোদনের দায়িত্ব নৌ অধিদপ্তর থেকে প্রত্যাহার করে একাধিক সংস্থার বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বতন্ত্র নকসা অনুমোদন কমিটি গঠন।


১৭. ত্রুটিপূর্ণ নৌযান চলাচল বন্ধে যথাযথভাবে ফিটনেস পরীক্ষার জন্য শূন্যপদগুলোতে অবিলম্বে নিয়োগ দিয়ে নৌ অধিদপ্তরের ‘শিপ সার্ভেয়ার’ সংকট নিরসন ও বার্ষিক সার্ভে প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ।  


১৮. কোন শিপ সার্ভেয়ার কোন মাসে কতোগুলো নৌযান নিবন্ধন ও সার্ভে করছেন নামসহ সেই তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ।  


১৯. দক্ষ নৌযানচালক তৈরির লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিসহ এ ধরনের কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ‘অভ্যন্তরীণ মাস্টারশিপ-ড্রাইভারশিপ পরীক্ষা বোর্ড’ গঠন, পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কার ও পরীক্ষার্থীদের ন্যুনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি বা সমমানের নির্ধারণ।


২০. নৌ অধিদপ্তর থেকে সমুদ্রগামী নাবিকদের সার্টিফিকেট অব প্রফিসিয়েন্সি (সিওপি), অভ্যন্তরীণ নৌযানচালকদের সনদ নবায়নসহ অন্যান্য সেবা ও নৌযানমালিকদের নিবন্ধন-বার্ষিক ফিটনেস সনদ পেতে অহেতুক কালক্ষেপন, অর্থব্যয় ও হয়রানি বন্ধ।


২১. নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৌ অধিদপ্তরকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে পূর্ণাঙ্গ জনবল নিয়োগ, দ্রুতগতির টহলবোটসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক জলযান ও কর্মকর্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় গাড়ি বরাদ্দ।


২২. রাজস্ব আদায় ও নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সারা দেশে বৈধ-অবৈধ সব ধরনের নৌযানের সংখ্যা নির্ধারণে অবিলম্বে জাতীয় নৌশুমারির ব্যবস্থা গ্রহণ।  


২৩. নিবন্ধন ও ফিটনেসবিহীন নৌযানের বিরুদ্ধে বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ অধিদপ্তরকে নিয়মিত ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার নির্দেশনা প্রদান। এ কাজে সহায়তার জন্য নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ডের পাশাপাশি জেলা-উপজেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশকে সম্পৃক্তকরণ।


২৪. নদী খনন ও নৌপথের পলি অপসারণ কাজের গতি বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চলমান প্রকল্পগুলোর তথ্য সবিস্তারে বিআইডব্লিউটিএর ওয়েবসাইটে প্রকাশ।  


২৫. বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএসহ সকল সরকারি দপ্তরের নৌযানসমূহকে হালনাগাদ সার্ভের আওতায় আনা ও নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থাগুলো থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ।