করোনাঃ নারায়ণগঞ্জে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে স্বেচ্ছায় বদলি হলেন ডা. মশিউর
করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের দুর্দশা ও কষ্ট দেখে তাদের চিকিৎসা করানোর জন্য নিজেই আবেদন করে বদলি হয়ে নারায়ণগঞ্জ এসেছেন চিকিৎসক মশিউর রহমান। তিনি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় কর্মরত ছিলেন।
বুধবার (৬ মে) সন্ধ্যায় গণমাধ্যমের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় স্বেচ্ছায় বদলির কারণ ব্যাখ্যা করেন তিনি। মশিউর রহমান ৩৯তম বিসিএস’র স্বাস্থ্য ক্যাডারের নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক। তার নানা একজন বীরউত্তম খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। পিলখানার তিন নম্বর গেইটটি তার নানার নামে নামকরণ করা হয়েছে। তিনি হলেন বীরউত্তম সুবেদার হাবীবুর রহমান।
মশিউর রহমান বলেন, ‘আমি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় কর্মরত ছিলাম। কিন্তু সেখানে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত কোনও করোনা রোগী ছিল না। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে আমাদের চিকিৎসকরা করোনা রোগীদের চিকিৎসা করতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু চিকিৎসক তো সবজায়গায় সীমিত। আমি দেখলাম সিরাজগঞ্জে বসে থেকে কোনও লাভ নেই। তাই মনে মনে ইচ্ছা জন্মালো আমি যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সেবা করতে পারতাম। জাতির এইসময় যদি পাশে দাঁড়াতে পারি তাহলে আমার মেধা ও পরিশ্রম কাজে লাগবে। কিন্তু হঠাৎ করে উপায় মিলছিল না। তাই উপায় খুঁজতে লাগলাম। যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বদলি হতে চাই, তাহলে ফাইল চালাচালি ও অর্ডার হতে সময় লাগবে। তাই আমি নিজেই ২৫ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরে মহাপরিচালক বরাবর নারায়ণগঞ্জে বদলি হওয়ার জন্য আবেদন করলাম। এরমধ্যে আমি আমার মায়ের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করছি। মা তখন আমাকে বলল, সব উপজেলা ও জেলাই তো আক্রান্ত হতে পারে। তুমি যদি নারায়ণগঞ্জ যেতে চাও সিদ্ধান্ত তোমার। আমি মাকে বুঝালাম যথাযথ প্রটেকশন পেলে ভাইরাস আক্রান্ত হবো না। আমার পরিবার আমার সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন। তারা সায় দিলেন। তবে তাদের দুশ্চিন্তা কমে না।’
বদলির আবেদনে যা লিখেছিলেন ডা. মশিউর
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর করা আবেদনে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি ডা. মশিউর রহমান, সহকারী সার্জন, দোবিলা ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, তাড়াশ, সিরাজগঞ্জে কর্মরত আছি। দেশের ক্রান্তিলগ্নে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় করোনা রোগীদের সেবাদানের জন্য আইসোলেশন সেন্টার এবং করোনা নিবেদিত হাসপাতালসমূহে সরকারি ডাক্তারদের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় আমি, ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের যে কোনও জেলায় করোনা টিমে বদলি হয়ে করোনা রোগীদের সেবা করতে ইচ্ছুক। উল্লেখ্য যে, আমার নানা বীর উত্তর সুবেদার হাবিবুর রহমান ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বিজিপি পিলখানার সদর দফতরের ঢাকা নিউ মার্কেট সংলগ্ন ৩ নম্বর গেইট এর নাম বীর উত্তম হাবিবুর রহমান গেইট। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি নিজের জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘ ৪৬ বছর তিনি পঙ্গু থাকার পর ২০১৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। নানার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আমিও করোনা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাই।
অতএব, উপরোক্ত বিষয়সমূহ বিবেচনা করে আমাকে ঢাকা, গাজীপুর বা নারায়ণগঞ্জ জেলার যে কোনও করোনা রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে বদলি করে রোগীদের সেবা করার সুযোগ দানে হুজুরের সদয় মর্জি হয়।’
এই আবেদন করার দুদিন পর ২৭ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে চিকিৎসক মশিউর রহমানের বদলির অর্ডার হয়।
মশিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের বদলির প্রক্রিয়াটি জেলা সিভিল সার্জনদের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তবে সেই প্রক্রিয়ায় সময় লাগতো। তাই সরাসরি ডিজি’র কাছে আবেদন করেছি।’
সরাসরি চলে এসেছেন নারায়ণগঞ্জে
মশিউর রহমান সিরাজগঞ্জে বসেই করোনাভাইরাস আক্রান্তরোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তাই ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে বদলির অর্ডার হওয়ার পরপরই তিনি নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন। মশিউর রহমান বলেন, ‘আমি মানুষের দুরবস্থা দেখে সেবার ইচ্ছা নিয়েই এখানে চলে এসেছি। আমি যখন আসি তখন এখানে আমাদের কয়েকজন সহকর্মী আক্রান্ত ছিলেন। তবে সবাই রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।’
তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ প্রোটেকশন ব্যবস্থার পিপিই সরবরাহ করা হয়েছে। এখানে সবাই প্রয়োজনীয় পিপিই পাচ্ছেন। রোগীরাও আমাদের সেবায় খুশি। এখান থেকে সুস্থ হয়ে অনেক রোগীই খুশি মনে ফিরছেন। তবে মনটা খারাপ হয়ে যায় কেউ মারা গেলে। আমরা দিনরাত পরিশ্রম করছি যাতে একজন মানুষও তার স্বজন না হারায়।’
রোগীদের সঙ্গে মশিউর রহমানের প্রায়ই কথা হয়। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে এই হাসপাতালে ৭১ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। অনেকের সঙ্গে কথা হয়। তাদেরকে আশ্বস্ত করি, বলি যে আমি ইচ্ছা করেই আপনাদের চিকিৎসার জন্য বদলি হয়ে এখানে এসেছি, আপনারা মনোবল শক্ত করেন। কিছু হবে না, আমাদের পরামর্শ মেনে চলুন। তখন রোগীরাও অবাক হয়। তারা বলে, আমাদের স্বজনরা কেউ কাছে আসে না, আর আপনি সিরাজগঞ্জ থেকে ইচ্ছা করে বদলি হয়ে এসেছেন!’
মশিউর রহমানের এই সিদ্ধান্তে তার সহকর্মীদের ছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তবে অনেকেই তাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। অনেক চিকিৎসক তাকে বলেছেন, সবাইতো এত সাহস দেখাবে না। এজন্য মশিউরের বর্তমান হাসপাতালের সহকর্মীরাও প্রশাংসা করেছেন। মশিউর রহমান এই হাসপাতালের সর্বকনিষ্ঠ চিকিৎসক। তাকে সবাই সহযোগিতা করছেন। নারায়ণগঞ্জের এই হাসপাতালে সহমর্মিতার পরিবেশ খুব ভালো।
নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে করোনা রোগীদের আবাসিক ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানেই থাকছেন মশিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান আমাদের আবাসন, খাবার ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করেছেন। এখানে আমাদের খাবার ও থাকার জায়গার মান খুবই ভালো।’
তিনি বলেন, ‘নানার কাছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনা শুনছি। এসব শুনে দেশসেবায় ছোটবেলা থেকে উজ্জীবিত হয়েছি। তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাছাড়া আমরা না এগিয়ে আসলে কেউ মানুষ কোথায় সেবা পাবে। এটা আমাদের দায়িত্ব। দায়িত্ব থেকে কারও পালানোর উপায় নেই।’
মশিউর রহমানের গ্রামেরবাড়ি ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার সদরে। তিন ভাই ও এক বোনের ভেতরে তিনি সবার বড়।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।