অতিরিক্ত ‘দেনমোহর’ বাড়াচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদ-কলহ

নিজস্ব প্রতিবেদক
ইনিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: সোমবার ৭ই নভেম্বর ২০২২ ০৬:৪০ অপরাহ্ন
অতিরিক্ত ‘দেনমোহর’ বাড়াচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদ-কলহ

ফেনী শহরের তরুণ ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। কয়েক বছর প্রেমের সম্পর্কের পর পারিবারিকভাবেই বিয়ে করেন। বিয়ের সময় দেনমোহর ধরা হয় ২৫ লাখ টাকা। আশরাফুলের পরিবার বিশাল অংকের এই দেনমোহরের কারণে নাখোশ থাকলেও কনের পরিবার এই শর্তেই বিয়েতে রাজি হয়। প্রথম দুই বছর দুজনের সম্পর্ক ভালোই ছিল। এরপর শুরু হতে থাকে টানাপোড়েন। নানা বিষয়ে বিভিন্ন সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়। ঝগড়া হলেই উঠে আসে কাবিন প্রসঙ্গ। আশরাফুলের স্ত্রীর একটাই কথা, ‘ভালো না লাগলে দেনমোহরের টাকা দিয়ে বিদায় দাও। আর যদি সেই মুরোদ না থাকে যা বলি তাই শোনো। ’ 


আশরাফুল জানান, প্রায়ই শারীরিকভাবে আঘাত করেন তার স্ত্রী, মানসিকভাবেও যন্ত্রণা দেন। লজ্জায় কাউকে বলতেও পারি না আবার সইতেও পারি না, কিছু বললেই শুনতে হয় দেনমোহরের টাকার কথা। এমনটা জানলে এত টাকা দেনমোহরের শর্তে বিয়ে করতাম না।  


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এমন ঘটনা একটি-দুটি নয়, অসংখ্য। সারা দেশেই বিয়েতে অতিরিক্ত দেনমোহর নিয়ে চলছে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এই প্রবণতা যেমন অস্বস্তি আর কলহ বাড়াচ্ছে, তেমনি গড়াচ্ছে বিচ্ছেদ পর্যন্ত।


সম্প্রতি প্রবাসী অধ্যুষিত ফেনীতে এমন ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন বিভিন্ন মহল। সেখানকার তালাকপ্রাপ্ত নারী-পুরুষের তথ্য, পারিবারিক আদালতের নথি ও অভিযোগে যে বর্ণনা-তার বেশিরভাগেরই উদ্যেশ্য হলো দেনমোহর ও খোরপোষের টাকা আদায় করা। গত অর্থবছরে ফেনীতে ১২ হাজার ৬৪৯টি নিবন্ধিত বিয়ের মধ্যে ৪৭২টি তালাকের ঘটনার তথ্য রয়েছে জেলা রেজিস্ট্রার অফিসেই।


সামাজিক বিয়ে মানেই ধুমধাম স্বজনদের হৈ হুল্লোড়, আনন্দ আর আতশের ঝলকানি। দেনমোহরের টাকা হয়ে যায় হরিষে বিশাদ। এই টাকার জন্য প্রতিনিয়তই ভাঙছে অনেক সংসার। অনেক সংসারে লেগে আছে কলহ।  


ফেনী জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের তথ্য মতে, চলতি বছরের ৯ মাসে তাদের অফিসে স্বামী-স্ত্রীর বিভিন্ন বিরোধে ৪২৮টি অভিযোগ জমা পড়েছে। যার আড়াইশটির বাদী নারী আর ১৭৮টির পুরুষ। অভিযোগের ৯০ ভাগই স্বামী-স্ত্রীর লড়াই। পর্যালোচনায় ৯০ ভাগ পুরুষ ভুল সুধরিয়ে সংসার টিকিয়ে রাখাতে চাইলেও নারীদের ক্ষেত্রে ৯৫ ভাগের বেশি কাবিনসহ আনুষাঙ্গিক খরচ বুঝে নিয়ে সংসার জীবনের ইতি টানার পক্ষে। বিচ্ছেদ চাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষদের দেনমোহর ৫ লাখ টাকার নিচে হলেও নারীদের ক্ষেত্রে তা ১০ লাখ টাকার ওপরে। মাত্রাতিরিক্ত দেনমোহরের ফলে স্ত্রীদের পক্ষ থেকে তালাক দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করেন অনেকে।  


কবির আহম্মদ নামের একজন জানান, ৫ বছর আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বিয়ে করে চলে যান দেশের বাইরে। এর মাঝে দুবার দেশে এসেছেন। হয়েছে একটি পুত্র সন্তানও। কিন্তু আবার বিদেশে যাওয়ার পর স্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন কারণে সংসারে অশান্তি তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত তালাকের পর্যায়ে যায়। অবশেষে দেনমোহরের ১০ লাখ টাকা শোধ করে বিচ্ছেদ হয়।  


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, এমন আরও ঘটনা আছে। সামাজিক অবস্থানের কারণে তারা বলতেও পারছেন না আবার সইতেও পারছেন না।  


এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন, রাজিয়া আক্তার নামের বিচারপ্রার্থী নারী। ফেনী জজ কোর্টের আঙিনায় দেখা হওয়া এ নারী জানান, বিয়ে হয়েছে তিন বছর হয়েছে। হঠাৎ করে তিনি জানতে পেরেছেন স্বামীর অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক আছে। এমন পরিস্থিতিতে সংসারতো আর সম্ভব নয়। দেনমোহর যেহেতু অধিকার তাই অধিকার বুঝে নিতে হবে। এটি একজন নারীর নিরাপত্তার প্রশ্ন। দেনমোহরের টাকার কারণেও অনেক পুরুষ নিয়ন্ত্রণে থাকে।  


চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত দেনমোহর ও খোরপোষ দাবিতে ফেনীর পারিবারিক আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৮৮টি। বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৩৬টি। এদিকে ৬০০টির অধিক মামলা নিষ্পত্তির পরও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে চলমান ১৭৬০টি মামলা। যার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই যৌতুকের মামলা।  


এ বিষয়ে কথা হয় ফেনী জজ কোর্টের আইনজীবী তারেক আজিজের সঙ্গে। তিনি জানান, দেশীয় রীতিনীতি অনুযায়ী ব্যক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদা এবং আর্থিক অবস্থানের আলোকে দেনমোহর নির্ধারিত হওয়া উচিৎ। মাত্রাতিরিক্ত দেনমোহরের বিষয়টি সম্প্রতি উদ্বেগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই ধরনের দেনমোহর প্রচলিত নিয়মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।  


ফেনী আলিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মো. মাহমুদুল হাসান বিষয়ে বলেন, ইসলামে দেনমোহর নারীর অধিকার। এটি স্বামীকে পরিশোধ করতে হয়। তবে বর্তমানে সমাজে যেভাবে কাবিনের বিষয়টি প্রচলন হচ্ছে, অনেক টাকা লিখে রাখা হয় কিন্তু তাৎক্ষণিক নগদে পরিশোধ করা হয় না। এটা ইসলামি রীতি নয়। সর্বোত্তম হলো দেনমোহর বা মোহরানা পরিশোধ করে তারপর স্ত্রীকে স্পর্শ করা। এর আগে নয়। আর দেনমোহর হতে হবে সামর্থ্য অনুযায়ী।   


শুধু আইন দিয়ে নয়, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে বলে মনে করছেন ফেনী জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট হাফেজ আহম্মদ।