আবারও সমালোচনার মুখে মৃণাল হক

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ৩১শে জানুয়ারী ২০১৯ ০৫:৫৫ অপরাহ্ন
আবারও সমালোচনার মুখে মৃণাল হক

দেশি-বিদেশি সেলিব্রেটিদের ভাস্কর্য নিয়ে ‘সেলিব্রেটি গ্যালারি’ বানিয়ে আবারও সমালোচনার মুখে পড়েছেন ভাস্কর মৃণাল হক। যারা এরইমধ্যে গ্যালারি ঘুরে এসেছেন তারা বলছেন— প্রিয় সেলিব্রেটিদের এমন ‘বিকৃত চেহারা’ দেখে তারা হতাশ হয়েছেন। সরেজমিনে গিয়েও গ্যালারির কাজে যত্নের অভাব পরিলক্ষিত হয়। যদিও মৃণাল হক তার সৃষ্টির কোনও খুঁত দেখতে পান না। মাত্র ছয় মাসে তিনি  উদ্যোগটি সম্পন্ন করেছেন উল্লেখ করে ভাস্কর মৃণালের দাবি, ব্যক্তিগতভাবে তাকে অপছন্দ করে এমন মানুষেরাই সমালেচনা করছে, তার কাজ পাশের দেশের জাদুঘরের চেয়ে ভালো হয়েছে।

এর আগে সুপ্রিম কোর্টের সামনে গ্রিক দেবী থেমিসের অনুকরণে ভাস্কর্য স্থাপন করে সমালোচনার মুখে পড়েন এই ভাস্কর। সেসময় থেমিসের ভাস্কর্যটি সরানোর পক্ষে যুক্তি হিসেবে এর নান্দনিক ত্রুটির পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ঈদগাহের অবস্থানের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গ্রিক দেবীকে শাড়ি পরানো নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

গ্রিক দেবী ছাড়াও রাজধানীতে বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য রয়েছে মৃণাল হকের। তিনি বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে নিজ উদ্যোগে ভাস্কর্য তৈরি করেছেন এবং বেশিরভাগ কাজের শিল্পমান নিয়ে বিভিন্ন সময় সমালোচনার মুখে পড়েন। সমালোচকরা বলে থাকেন, ভাস্কর্য নির্মাণে তিনি মনোযোগী নন এবং তার কাজে কিছু অবাস্তব দিক থেকে যায় অসাবধানতার কারণেই। আর  মৃণাল হক বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বিনা পয়সায় ভাস্কর্য তৈরি করে দেন বলে যে দাবি করে থাকেন, সেটিরও সমালোচনা করে কেউ কেউ বলছেন— বিনা পয়সায় দিলেই শিল্পমানহীন ভাস্কর্য উপস্থাপন ঠিক না।

শুরুতে ৩২ জন ব্যক্তিত্বের ভাস্কর্য নিয়ে পথচলা শুরু করছে এই গ্যালারি। এই খ্যাতিমানদের মধ্যে স্থান পেয়েছেন, কাব্যচর্চায় মগ্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কারারুদ্ধ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মহাত্মা গান্ধী, সাদা শাড়িতে মানবতার দূত মাদার তেরেসা, রাইফেল কাঁধে বিপ্লবী চে গুয়েভারা, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, পপ গানের রাজা মাইকেল জ্যাকসন, গায়িকা শাকিরা, ফাঁসির মঞ্চে ক্ষুদিরাম, খ্যাতিমান অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন, মি. বিন খ্যাত রোয়ান অ্যাটকিনসন, পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ানের ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো, বলিউড তারকা শাহরুখ খান, বিখ্যাত কমেডি সিরিজ থ্রি স্টুজেস-এর তিন মূল চরিত্র, প্রিন্সেস ডায়না, বব মার্লে, অ্যাভাটার, রোবোকপ।

এদিকে, গ্যালারি উদ্বোধন হওয়ার পর কয়েকটি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সেখানে এই ধরনের বিকৃতির অবসান ঘটানোর দাবি জানিয়ে বিভিন্ন পোস্টে বলা হয়েছে, এধরনের বিকৃত জিনিস থাকার চেয়ে এরকম কোনও মিউজিয়াম ছিল না বাংলাদেশে, সেটাও অনেক ভালো ছিল। ৫০০ টাকার বিনিময়ে এই গ্যালারি দেখে এসেছেন মেসিভক্ত নাহিয়ান। হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আর্জেন্টিনার পোশাক দেখে আমি কোন খেলোয়াড় সেটা ভাবছিলাম। মেসি না বলে দিলে খোদ মেসিও বলতে পারবে না, এইটা তার ভাস্কর্য। পুরো বিষয়টাতে পরিশীলিত ভাবটা নেই। এটা বড় ধরনের ক্রাইম।’
সেলিব্রেটি মিউজিয়ামআবার ফেসবুকেই মৃণালের কাজকে সমালোচনা করলেও তাকে আঘাত করা ঠিক না এধরনের বক্তব্যও হাজির আছে। সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘মৃণাল হক তবুও কিছু করার চেষ্টা করেন... আমি অতটা বুঝি না ভাস্কর্য... কথা হলো বাকিরা কী করে? এক সময় শামীম শিকদারকে নিয়েও অনেক সমালোচনা হতো। তখনও আমরা শুনেছি, এসব ভাস্কর্যের কিছুই ঠিক নেই, শেপ নেই, নান্দনিকতা নেই। যারা বলেছে তারা কিছু করেনি। শামীম শিকদারের করা সেইসব ভাস্কর্যই এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা সৌন্দর্য।’ ইশতিয়াক রেজার স্ট্যাটাসের  কমেন্টবক্সেও চলছে সমালোচনার ঝড়। এমনকি মৃণাল হকের নিজের পোস্টে কমেন্ট বক্সে চলছে নানা সমালোচনা।  এধরনের বিকৃত ভাস্কর্য বানানোয় তাকে নানাভাবে হেয় করেও কমেন্ট করেছেন কেউ কেউ।

এদিকে, নির্বিকার মৃণাল হক বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে বলার জন্য অনেক শিল্পীরা আছেন, আমার ক্লাসমেটরা আছেন। তারা আজীবনই আমার কাজ নিয়ে নানা মন্তব্য করছেন। যারা সমালোচনা করছেন গ্যালারির, তারা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করেন। সেদিন গ্যালারিতে মধ্যবয়সী কিছু যুবক ফুটবলটা নিয়ে ফুটবল খেলা শুরু করলো। আমি তাদের জোর করে থামিয়েছি। সেটাও দোষ হয়েছে। তারাই এসব করছে।’ মাইকেল জ্যাকসনের ভাস্কর্যকোন জায়গা থেকে এধরনের গ্যালারি করলেন, প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সেলিব্রেটি গ্যালারি নেই, হওয়া উচিত এজন্য শুরু করেছি।’ আপনার এই কাজ তো গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। বিকৃতির অভিযোগ এসেছে, জানানো হলে তিনি বলেন,‘আমার বিরুদ্ধে বলার জন্য অনেক শিল্পী আছে, আমার ক্লাসমেটরা আছে। কলকাতার মিউজিয়ামের সঙ্গে তুলনা করেন। মাত্র ছয় মাসে আমি কাজ শেষ করেছি। কিন্তু ফান্ডের অপ্রতুলতার কারণে জোড়াতালি দিয়ে এসব করা সম্ভব না, ফান্ড দরকার।’

মৃণাল হকের সেলিব্রেটি মিউজিয়ামঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শিল্পী আবুল বারক আলভী বলেন, ‘যখন কোনও আদল  তৈরি করা হয়, তখন অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। কেননা, বিষয়টি সংবেদনশীল। আর সেলিব্রেটিদের ক্ষেত্রে সেটি আরও সতর্কতার বিষয়। কারণ, তাদের অবয়ব সবার মুখস্থ।’ তিনি আরও  বলেন, ‘এধরনের গ্যালারি দেশের বাইরে আমরা যেগুলো দেখেছি, সেগুলোতে খুবই দক্ষ শিল্পীদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে, যারা এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। কত  দ্রুত মানুষের সামনে হাজির করলাম, তার চেয়ে জরুরি, কত নিখুঁতভাবে হাজির করতে পারলাম।’

ইনিউজ ৭১/এম.আর