‘সরকার বলে ঘরে থাকতে, মালিক বলে রাস্তায় বের হও’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: রবিবার ২৬শে এপ্রিল ২০২০ ০৪:২৭ অপরাহ্ন
‘সরকার বলে ঘরে থাকতে, মালিক বলে রাস্তায় বের হও’

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে আগামী ৫ মে পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে সাধারণ ছুটি। এরই মধ্যে আগামীকাল থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে চালু হচ্ছে পোশাক কারখানা। এর জের ধরে নিজ নিজ কর্মস্থলে ছুটে চলেছেন পোশাক শ্রমিকরা। এতে করোনার সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন শ্রমিক সংগঠনের নেতা ও সংশ্লিষ্টরা।   

‘সরকার বলে ঘরে থাকতে, মালিক বলে রাস্তায় বের হও’ 

শনিবার বিকেল ৪টার পর থেকে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় পোশাক শ্রমিকদের বিভিন্ন মহাসড়ক দিয়ে হেঁটে ও রিকশাযোগে যাতায়াত করতে দেখা গেছে। গাজীপুর সদর উপজেলার বাঘের বাজার এলাকার কর্টেজ গার্মেন্টস লিমিটেডের ফিনিশিং শাখার সিনিয়র অপারেটর হাসিনা আক্তার। বাড়ি নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুর উপজেলার লক্ষীপুরা গ্রাম থেকে ফিরেছেন তিনি। হাসিনা বলেন, “সরকার আর গার্মেন্টস মালিকেরা আমাদেরকে নিয়ে মরণ খেলা খেলতেছে। সরকার বলে ঘরে থাকতে, মালিক বলে রাস্তায় বের হও। আমাদের কোনো উপায় নেই।”

বিকেল সাড়ে ৫টায় সদর উপজেলার ভবানীপুর এলাকায় হাতে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন সাইফুল ইসলাম। তিনি গাজীপুর মহানগরের সাইনবোর্ড এলাকার ইভা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের শ্রমিক। টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার মোটেরবাজার এলাকা থেকে কর্মস্থলে যোগ দিতে এসেছেন তিনি। আগামীকাল কারখানায় না গেলে এপ্রিলের বেতন-ভাতা পাবেন না, এমনকি চাকরিও যেতে পারে-এমন ভয় পাচ্ছেন তিনি। 

এমনই আরেকজন পোশাক শ্রমিক শেরপুরের নকলা উপজেহলার ভানুসার্দি এলাকার শান্ত মিয়া। তিনি গাজীপুর সদর উপজেলা ভাওয়াল মির্জাপুর এলাকার তালহা ফেব্রিক্স লিমিটেডের শ্রমিক। গাজীপুরে ভাড়া বাসায় ছিলেন। ১৬ এপ্রিল বেতন নিয়ে শেরপুরে বাড়ি চলে যান তিনি। সে সময় তার প্রতিবেশী ভাড়াটিয়ারা যারা বাড়ি থেকে এসেছিলেন তাদের কাউকে বাড়িওয়ালারা বাসায় উঠতে দেননি। তিনি নিজেও আজ বাড়িওয়ালার সঙ্গে যোগাযোগ করে আসেননি। বাড়িওয়ালা
বাড়িতে উঠতে দেন কিনা সেই শঙ্কায় আছেন তিনি।

এসব বিষয়ে গাজীপুর মহানগরের কড্ডা নাওজোর এলাকার পলমল গ্রুপের কোয়ার্টজ অ্যাপারেলস লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (মানব সম্পদ ও প্রশাসন) সৈয়দ শামসুর রায়হান বলেন, “ছুটি দেওয়ার সময় কোনো শ্রমিককে বাড়ি যেতে বলা হয়নি। তাছাড়া যারা বাড়ি গেছে তাদেরকে ডাকা হয়নি। যারা কারখানার আশপাশে রয়েছে তাদেরকে দিয়ে, তথা ৩০ ভাগ শ্রমিক দিয়ে উৎপাদন চালু রাখব। যারা আসতে পারবে না তাদের চাকরি চলে যাবে এমনটি বলা হয়নি। আমরা বিজিএমইএ’র নির্দেশনা মেনে চলব। আর করোনা পজেটিভ বা নেগেটিভ এমন নিশ্চয়তা দেওয়ার সুযোগ কারখানা কর্তৃপক্ষের নেই।”

একই চিত্র সাভার-আশুলিয়ায়

আগামীকাল থেকে সাভার ও আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চল এলাকায় চালু হচ্ছে অনেক কারখানা। ইতিমধ্যে মালিকপক্ষের লোকজন শ্রমিকদের মোবাইল ফোনে কল ও খুদে বার্তার মাধ্যমে কারখানায় কাজে যোগ দেওয়ার জন্য বলেছেন। দেশে  করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই মুহুর্তে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকদের ঢাকায় নিয়ে আসলে তা আবারও ভয়াবহ রূপ নিতে বলে আশঙ্কা করছে শ্রমিক সংগঠনের লোকজন। 

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন বলেন, সাভারের অনেক কারখানার মালিক শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। অনেক শ্রমিক এখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে। আবার শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিলে তাদেরকে চাকরি হারানোর ভয়ও রয়েছে। সেক্ষেত্রে গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকরা রিকশা, ভ্যান ও ট্রাকে করে ঢাকায় আসবে। এর আগেও একই ধরনের ভুল করা হয়েছিল। তবে এবারও সেই রকম ঘটনা ঘটলে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির শিকার হতে পারে। এই অবস্থায় কারখানা চালু না করা উচিত। 

এ বিষয়ে সাভার শিল্প পুলিশ-১ এর সহকারী পুলিশ সুপার বলেন, কাল অনেক কারখানা চালু হওয়ার বিষয়টি তিনি শুনেছেন। পুলিশের পক্ষ থেকেও শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নেওয়া হবে। কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে কিনা তাও দেখা হবে। 

সড়ক ও নৌপথে শ্রমিকের ভীড়

শনিবার সকাল থেকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথ ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে দেখা গেছে কর্মস্থলে ফেরা মানুষের ভীড়। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে নিষিদ্ধ যানবাহনে যাতায়াত করতে দেখা যায় তাদের।

মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পোশাক শ্রমিক সোবহান হোসেন জানান, তিনি সাভারের একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। কাল তার কারখানা খুলবে। না গেলে চাকরির সমস্যা হতে পারে। এমন অবস্থায় করোনাভাইরাসের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে বাড়তি ভাড়া দিয়ে কর্মস্থলের দিকে যাচ্ছেন তিনি। 

এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (টিআই) মো. রাসেল আরাফাত বলেন, শুক্রবার রাত থেকে ঢাকামুখী গার্মেন্টস কর্মীদের ভীড় চোখে পড়ছে। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক পুলিশ সদস্যরা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন। কোনো ধরনের গণপরিবহনকে সড়কে চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে, মানুষ তার জীবিকার প্রয়োজনে অনেকে হেঁটে যাচ্ছেন। 

ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব