৮ ডিসেম্বর: হানাদারমুক্ত বরিশাল, জয় বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত রাজপথ

নিজস্ব প্রতিবেদক
এইচ.এম.এ রাতুল, জেলা প্রতিনিধি, বরিশাল।
প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ৭ই ডিসেম্বর ২০২৩ ০৫:৪৬ অপরাহ্ন
৮ ডিসেম্বর: হানাদারমুক্ত বরিশাল, জয় বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত রাজপথ

আগামীকাল ৮ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে মুক্ত হয়েছিল বরিশাল। সেদিন বরিশালের আকাশ-বাতাশ প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল হাজার হাজার মানুষের মুখে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে। বাঁধা ভাঙ্গা ¯্রােতের মত মানুষ নেমে আসে শহরের রাজপথে। উড়িয়ে দেয়া হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।


সূত্রমতে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ “অপারেশন সার্চলাইট” এর মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শুরু করে গণহত্যা। ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার খবর বরিশালে টেলিফোনে আসে। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার তারবার্তা বরিশাল পুলিশ লাইনের ওয়ারলেস যোগে পোঁছে বরিশাল জেলা আওয়ামীলীগের তৎকালীন সাধারন সম্পাদক এ্যাড. নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের কাছে। গভীর রাতে পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার ভেঙ্গে বিপুল সংখ্যক অস্ত্র করায়ত্ত করে নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। ২৬ মার্চ ভোরে মুক্তিযোদ্ধাদের শপথ পড়িয়ে অস্ত্র হাতে তুলে দেয়া হয়। নুরুল ইসলাম মঞ্জুর মুহুরি মান্নানকে পাঠানো হয় মেজর এম এ জলিলকে আনার জন্য। সকালে বগুরারোডস্থ সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথম দক্ষিণাঞ্চলীয় সচিবালয় গঠিত হয়। এই সচিবালয়ের মাধ্যমে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ভারত থেকে অস্ত্র আমদানি, গল্লামারির যুদ্ধ, চাদপুরে অস্ত্র প্রেরণ সহ বেশ কয়েকটি অপারেশন করে। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করা হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অর্ন্তভুক্তি ও ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণের ব্যবস্থা করা হয় । এর আগে যুব সংঘের তৈরী মলোটভ ককটেল, হ্যান্ড গ্রেণেড বিভিন্ন স্থানে অপারেশনের জন্য পাঠানো হয়। 


১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদাররা আকাশ পথে বরিশালে প্রথমে হামলা চালায়। বঙ্গবন্ধু উদ্যান, মেডিকেলের সামনে, কীর্তনখোলা তীরে জঙ্গি ফাইটার দ্বারা বোমা নিক্ষেপ করা হয়। বোমায় বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। পরে ২৫ এপ্রিল তারা জল, স্থল ও আকাশ পথে দ্বিতীয় দফা আক্রমন চালায়। স্থল পথে বরিশাল আসার পথে বরিশাল জেলার সড়ক পথে গৌরনদীতে প্রথম বাঁধাগ্রস্থ হয় হানাদার বাহিনী। বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের গৌরনদীর কটকস্থল নামক ব্রীজে আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীকে আবুল হাশেমের নেতেৃত্বে মুক্তিযোদ্ধার একটি দল মাত্র রাইফেল নিয়ে বাঁধা দেয়। অবশ্য পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে মুক্তিবাহিনী টিকতে পারেনি। এতে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবুল হাসেম, মোক্তার আলী, আলাউদ্দিন আহম্মদ এবং পরিমল। অপর দিকে পাকিস্তানি নৌ-বাহিনী গান বোট যোগে সকাল ৯টা নাগাদ শহরে ঢোকার চেষ্টা করে। তখন শহরতলী শায়েস্তাবাদের তালতলী নদীর জুনাহারে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাথে তাদের সম্মুখে যুদ্ধ হয়।


আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক একং ক্যাপ্টেন মেহেদীর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ইরানি ও মাছবি নামে দু’টি যাত্রীবাহী ষ্টিমার নিয়ে দেশী বন্ধুক ও ৩০৩ রাইফেল দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। পাকিস্তানি বাহিনীর কামানের গোলায় ষ্টিমার ও লঞ্চটি ডুবে যায়। একই সাথে তারা বিমান দিয়ে ছত্রীসেনাও নামায়। এসময় পরিস্থিতি দেখার জন্য নুরুল ইসলাম মঞ্জু একটি জিপ গাড়ী কামাল উদ্দিন ফিরুকে নিয়ে আসলে তারা পাকিস্তানি আর্মি ও গুলির নিশানায় পড়ে। পাকিস্তানি আর্মির গুলিতে আহত হন কামাল উদ্দিন ফিরু (কর্ণেল কামাল উদ্দিন)। পাকিস্তানি আর্মির ভারী আস্ত্রের কাছে টিকতে না পেরে বাধ্য হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সরে যার। পাকিস্থানী বিমান বাহিনীর কয়েকটি হেলিকপ্টর থেকে শহরের উপকন্ঠে চরবাড়ীয়া ও কাশীপুরে ইছাকাঠী গার্ডেনে ছত্রীসেনা নামানো হয়। চরবাড়িয়ায় পাকিস্তানি আর্মি ঢুকে নির্বিচারে সাধারন মানুষ হত্যা করে। এখানে অর্ধশতাধিক মানুষকে তারা হত্যা করে, জ্বালিয়ে দেয় বহু ঘর বাড়ি।


আরো জানা যায়, পাকিস্তানি বাহিনী সন্ধ্যা নাগাদ শহরে ঢুকে নির্বাচারে মানুষ হত্যা করে। সেনাবাহিনী প্রথমে অশ্বিনী কুমার হল পরে জিলা স্কুলে এবং সর্বশেষে ওয়াপদায় তাদের হেড কোয়ার্টার গড়ে তোলে। এখানেই তৈরী করা হয় নির্যাতন কক্ষ। সৈন্যরা ওয়াপদা এলাকার পিছনে সাগরদী খালের উপর পরিত্যক্ত ব্রীজের উপর দাঁড় করিয়ে নিরীহ লোকজন ধরে এনে হত্যা করে উক্ত খালে ফেল দিত। পাকিস্তানি হানাদারদের বরিশাল দখলের পরের দিনই ২৬ এপ্রিল হানাদার বাহিনী বরিশালের বিশিষ্ট ইট ব্যবসায়ী হাজী আদম আলীকে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিয়োগ করেন।


তিনি তার পদ ফেলে রেখে চরকাউয়া তার ইটের ভাটায় চলে গেলে সেনাবাহিনী এ পদে কসাই মসজিদের ইমাম বশিরউল্লাহ আতাহারীকে নিয়োগ দেয়। পরবর্তিতে মুসলিমলীগ, নেজামী ইসলামী জামায়াতসহ সমমনা রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের নিয়ে মুসলিমলীগ নেতা শাজাহান চৌধুরী ও এডভোকেট আবদুর রব, শমসের আলী, আবদুর রহমান বিশ্বাসের নেতেৃত্বে পুর্ণাঙ্গ জেলা শান্তি কমিটি গঠন করা হয় । তখন এই সদস্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসাবে তারা কাজ করে।


৯ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ জলিল ক্যাপ্টেন শাহজাহানকে বরিশাল সাব সেক্টরের দায়িত্ব দিয়ে বরিশাল পাঠান। এ সময় তার নতুন নামকরন করা হয় ক্যাপ্টেন ওমর। ৬ সেপ্টেম্বর উজিরপুরের বরাকোঠা দরগাহবাড়ি প্রাইমারী স্কুলে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন বরিশাল সাব সেক্টর কমান্ডের হেড কোয়াটার। 


ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকে সীমান্তে একটির পর একটি শহর মুক্ত হতে থাকে। ৪ ডিসেম্বর যশোর শহরের পতন হলে বর্বর সৈন্যরা সেনা ছাউনী ছেড়ে পালিয়ে যায় খুলনায়। এ অবস্থা দেখে বরিশাল জেলার থানাগুলো থেকে (গৌরনদী বাদে) বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যরা পালিয়ে এসে বরিশাল ওয়াপদায় আশ্রয় নেয়। ৭ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একটি গোপন সভা হয়। সভায় শান্তি কমিটির এডভোকেট আবদুর রব, শাহজাহান চৌধুরী, আবদুল মজিদ, মতি মিয়া ও এরশাদ সহ আলবদর ও রাজাকার কমান্ডাররা উপস্থিত ছিলেন। সামরিক কর্মকর্তারা যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। সভায় বরিশাল ত্যাগ করে ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সেনাবাহিনী।


৭ ডিসেম্বর গভীর রাতে হঠাৎ করে বরিশালে কারফিউ ঘোষণায় মানুষ আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়ে। কারফিউ ঘোষণা হলেও শহরে কোন সেনাটহল ছিল না। এমনকি পুলিশ রাজাকারদের টিকিটিও দেখা যায়নি। অথচ অন্যদিনগুলোতে সব সময়ের জন্যই রাস্তায় সেনা, পুলিশ এবং রাজাকারদের টহলদারী থাকত। সড়ক পথ চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রেনে চলে যাওয়ার পাক হানাদাররা পালাবার পথ হিসেবে জল পথকেই বেছে নিয়েছিল। জাহাজ কিউ সহ একাধিক গানবোট, লঞ্চ ও কার্গো বরিশাল ষ্টিমারঘাটে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। গভীর রাতে ওয়াপদা থেকে সেনাবাহিনী, মিলিশিয়া, একাধিক শান্তি কমিটির নেতা কিউ জাহাজে অবস্থান নেয়। কিউ জাহাজ বরিশাল ত্যাগ করে রাত ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে। জাহাজের সামনে ছিল গান বোট ও কার্গো। অপর জাহাজটি বরিশাল ত্যাগ করেছিল সকাল ৪ টার পর। এ জাহাজেও পাকসেনা, মিলিশিয়া, শাহজাহান চৌধুরীসহ কয়েকজন রাজাকার ও দালাল ছিল। পাকিস্তানি আর্মি অতি গোপনে বরিশাল ঘাট ত্যাগ করে।


এদিকে বরিশাল শহরে কারফিউ কারনে নিস্তব্ধতা। বেলা বাড়তে থাকে। ক্রমশঃ মানুষের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। কারফিউ অথচ সেনা টহল নেই। রাজাকার আর দালালদের খবরদারী নেই। গত ন’মাসে তো এমনটি কখনও ছিল না। সকাল ৯টার পরে মানুষের পথ চলা শুরু হয় আলি-গলিতে। সবার প্রশ্ন কি হতে যাচ্ছে? সকাল ১০টার পরে বরিশালে ভারতীয় যুদ্ধ বিমান টহল দিতে শুরু করে। প্রথমে শহরবাসী নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিলেও কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পারে এ যুদ্ধ বিমান মিত্র বাহিনীর। সবাই রাজপথে বেড়িয়ে এসে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে। মাথার উপরে বোমারু বিমান নিচে উৎফুল¬ মানুষ। জয় বাংলা শে¬াগানে প্রকম্পিত শহর। মুক্ত বরিশাল। বাঁধা ভাঙ্গা ¯্রােতের মত মানুষ নেমে আসে শহরের রাজপথে। ৭ ডিসেস্বর সন্ধ্যায় সুলতান মাষ্টার তার দলবল নিয়ে নবগ্রাম রোডের চৌমাথা পর্যন্ত পৌছেছিল। ৮ ডিসেম্বর প্রথমে তিনি মুক্ত বরিশাল শহরে প্রবেশ করে কোতয়ালী থানা দখল করেন। পুলিশ বাহিনী আত্মসমর্পন করে। উড়িয়ে দেয়া হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।


এরপর লাকুটিয়া রোডে অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্যগণ শহরে প্রবেশ করে। তারা প্রথমে পাওয়ার হাউস ও পরে শহর হয়ে চরকাউয়া খেয়াঘাটে বরফকলে অবস্থান নেয়। গৌরনদীর বেইজ কমান্ডার নিজাম উদ্দিন হাওলাদার তার বাহিনী নিয়ে প্রবেশ করে বরিশাল। বাবুগঞ্জের বেইজ কমান্ডার আব্দুল মজিদ দুপুরের পরে বরিশাল টেক্সাটাইল মিলে ক্যাম্প গঠন করলেন। কুদ্দুস মোল¬া তার দল নিয়ে বরিশালে ঢুকে জেলখানার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং কারাগারে আটক থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি মুক্ত করে দেন। সাব সেক্টর কমান্ডার শাহজাহান ওমর ছিলেন বাকেগঞ্জে। ৯ ডিসেম্বর বিকেলে আহত অবস্থায় নৌকাযোগে পোর্ট রোড হাজী আদম আলী ঘাটে নেমে চলে যান সার্কিট হাউজে। তিনি সার্কিট হাউজে অবস্থান নেন।


এদিকে যে সব রাজাকার আলবদর পালিয়ে যেতে পারেনি তারা আশ্রয় নিল পাকসেনাদের ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে পরিচিত ওয়াপদায়। পাক সেনারা বাংকারে ঢুকে অস্ত্র তাক করে ঘোষণা করল নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ছাড়া আর কারও কাছে তারা আত্মসমর্পন করবে না।


মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নুরুল ইসলাম মঞ্জুর এম.এন.এ এবং লেঃ মাহফুজ আলম বেগের নেতৃত্বে সুন্দরবন অঞ্চল থেকে তিনশত মুক্তিযোদ্ধার বাহিনী লঞ্চের সাথে ৩৫ টি নৌকা নিয়ে বরিশাল আসে ১৭ ডিসেম্বর। ঐদিনই বিকেলে নুরুল ইসলাম মঞ্জু ও তার বাহিনীর কাছে ওয়াপদায় অবস্থানকারী রাজাকার ও আলবদরা আত্মসমর্পন করেন। শেষ হয় বরিশাল থেকে পাকিস্থানী দখলদারিত্ব। মুক্তিবাহিনী তখন দলে দলে শহরে প্রবেশ করছে, চারিদিকে জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে মুক্ত বরিশাল। এভাবেই মুক্ত হয়েছিল ন’মাসের অবরুদ্ধ বরিশাল। বিজয়ের গৌরবের মিছিলে একাত্ম হয়েছিল সেদিন হাজারো মুক্তিকামী মানুষ।