নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর বুকে পলো দিয়ে মাছ ধরা উৎসব

নিজস্ব প্রতিবেদক
রিফাত হোসাইন সবুজ, জেলা প্রতিনিধি, নওগাঁ
প্রকাশিত: মঙ্গলবার ৯ই এপ্রিল ২০২৪ ০৭:৪৭ অপরাহ্ন
নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর বুকে পলো দিয়ে মাছ ধরা উৎসব

বাঁশের তৈরি পলো নিয়ে কয়েক গ্রামের শত শত মানুষ দলবেঁধে নেমে পড়ে নদীর হাঁটুপানিতে। তাদের পলোর নিচে ধরা পড়ে নানা জাতের দেশীয় মাছ। এ সময় এক উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়। সে উৎসব দেখতে হাজির হয় নদীরপাড়ের অনেক মানুষ। সীমান্তের নওগাঁ জেলায় পলো দিয়ে মাছ ধরার উৎসবের চিত্র এটি


চৈত্র মাস। খাল-বিল, নদী নালা ও ডোবার পানি কমতে শুরু করেছে। এসব জলাশয়ে এখন স্বল্প পানি। ইরি-বোরো ধান আধা-পাকা অবস্থা। এসময় টাতে অনেকের হাতে তেমন একটা কাজ থাকে না। অবসর সময়ে সৌখির মাছ শিকারিরা দলবদ্ধ হয়ে পলো/হাউরি (চাপিজ¦ালা) নিয়ে জলাশয়গুলোতে মাছ শিকারের জন্য বের হন। মাছ পাওয়া বা না পাওয়া কোন বড় কথা না। সবাই একসাথে মাছ শিকার করতে বের হওয়ায় আনন্দের ব্যাপার। এ অবসরে অল্প পানিতে মাছ শিকারের মহোৎসব মেতে উঠেছে সবাই।


নওগাঁ সদর উপজেলার ছোট যমুনা নদী। এ নদীর কোথাও হাটু পানি আবার কোথাও বুক সমান। আবার কোথাও শুকিয়ে গেছে। মঙ্গল দুপুর দুপুরের দিকে ছোট যমুনা নদীর শীবপুর এলাকায় একদল সৌখিন শিকারী নদীতে নেমে মাছ শিকার করছে। মাথা ও কোমরে আটসাট করে গামছা বেঁধে অনেকটা আনন্দ নিয়েই প্রায় শতাধিক মানুষ সখের বসে মাছ ধরার উপকরণ নিয়ে নদীতে নেমেছে। যাদের অধিকাংশই যুবক। কেউ বা উদাম শরীরেও পানিতে নেমেছে। নেমেছেন মাছ ধরতে। পানিতে নেমে হৈ-হুল্লুর করে সবাই চাপিজ¦ালা দিয়ে মাছ শিকারে ব্যস্ত।


খাল-বিল, নদী-নালা ও ডোবাতে পানি কমে যাওয়ায় এখন বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে দল বেধে মাছ ধরার দৃশ্য চোখে পড়ার মতো। দলবদ্ধ হয়ে পানি শুকিয়ে আবার কোথায় পলো দিয়ে মাছ ধরা। দিনে রাতে সুতা-বড়শি দিয়ে নদী থেকে ধরা হচ্ছে বোয়াল মাছ। বড়শিতে খাদ্য গেথে ছুড়ে ফেলা হয় নদীর পানিতে। রাতে বাতি জেলে নদীর পাড়ে সুত বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে দেখা যায়। তবে সুতা-বড়শি দিয়ে মাছ ধরা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।


সকাল থেকে শুরু হয়ে চলে বিকেল পর্যন্ত। বিভিন্ন নদী ও জলাশয়গুলোতে দল বেধ সারি বদ্ধ হয়ে পানিতে ফেলা হয় চাপিজ¦ালা। যেখানে ফাঁদে পড়ে শোইল, টাকি ও বোয়াল। তবে কবে কোথায় মাছ ধরা হবে উপজেলার হাট ও বাজারে আগেই সবাইকে জানিয়ে দেয়া হয়। অনেকে আবার মোবাইল ফোনে জেনে নেন। গ্রাম থেকে ৮-১০ কিলোমিটার বা আরো দুরে পায়ে হেটে দলবদ্ধ হয়ে বেরিয়ে পড়েন মাছ শিকারে।


সদর উপজেলার শীবপুর গ্রামের বাসিন্দা জুয়েল হোসেন বলেন, কোথায় পলো দিয়ে মাছ ধরা হবে তা আগেই গ্রামের হাটে সবাইকে বলে দেয়া হয়। এরপর সকালে সবাই হাউরি (চাপিজ¦ালা) নিয়ে বেরিয়ে পরা হয়। বাপ-দাদার সময় থেকে আমরা প্রতি বছর পলো দিয়ে মাছ ধরা উৎসব করে আসছি। কারো পলোতে মাছ ধরা পড়ে আবার কারো হয়না। মাছ পাওয়াটা বড় কথা নয়, বড় কথা সবাই আনন্দ করে একসাথে মাছ ধরতে বের হয়। এটাই আনন্দ।


বদলগাছী উপজেলার বালুভরা গ্রামের নিপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন, গ্রাম থেকে অন্তত ৬ কিলোমিটার দূরে এখানে মাছ শিকার করতে এসেছি আমরা বেশ কয়েকজন। দলবদ্ধভাবে এভাবে মাছ ধরতে আমাদের খুব ভালো লাগে, অনেক আনন্দ পাই আমরা।


সদর উপজেলার কুমাইগাড়ী এলাকার জাহিদুল হক বলেন- ছোট বেলাতেও বাবার সাথে পলো দিয়ে এভাবে নদীতে মাছ ধরতাম। এখন তো বয়স প্রায় ৬০বছর এর মত। তবুও মাছ ধরা উৎসব হবে জানার পর না এসে আর থাকতে পারলামনা। আগে তো নদীতে বড় বড় নানা জাতের মাছ পাওয়া যেত। এখন অনেক সময় নদীতে পানি থাকেনা। মাছও তেমন পাওয়া যায়না আগের মত। তবে আনন্দ করছি এটাই ভালোলাগা।


জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মোঃ আমিমুল এহ্সান বলেন, কৃষির জেলা নওগাঁয় কিন্তু ছোট-বড় অসংখ্য নদ-নদী ও খাল-বিল রয়েছে। ছোট যমুনা নদী, পুণর্ভবা নদী, আত্রাই নদী, তুলশীগঙ্গা, শিব নদী, ফকিরনি নদী এবং নাগর নদী। বিল মুসছুর, গুটার বিল, দীঘলির বিল, জবই বিলসহ অসংখ্য ছোট বিলও আছে এখানে। আর নদীপারের আশপাশের গ্রামের মানুষ পলো দিয়ে মাছ ধরার উৎসবে মেতে ওঠে। এটি গ্রামবাংলার একটি প্রাচীন উৎসবের একটি অংশ। নতুন প্রজন্মের অনেকেই আবার এই উৎসবের আনন্দ উপভোগ করে থাকে। নদী পারে অনেক মানুষ মাছ ধরা উৎসব দেখতে ভির জমায়।