বরিশালে প্রাণ ফিরেছে বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারে

নিজস্ব প্রতিবেদক
এইচ.এম.এ রাতুল, জেলা প্রতিনিধি, বরিশাল।
প্রকাশিত: সোমবার ২০শে ডিসেম্বর ২০২১ ০৫:২৯ অপরাহ্ন
বরিশালে প্রাণ ফিরেছে বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারে

বই জ্ঞানের প্রতীক, বই আনন্দের প্রতীক। জ্ঞান আর আনন্দ ছাড়া মানব জীবন নিশ্চল হয়ে পড়ে। একটি ভালো বই-ই হচ্ছে মনের পুষ্টি যোগানোর অন্যতম উপায়। বৈশ্বিক মহামারী করোনায় সমগ্র বিশ্ব যখন স্তব্ধ হয়ে পড়ে তখন বিভিন্ন বয়সী বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ মূলত গৃহবন্ধী হয়ে পড়েন। বিশেষ করে শিশু-কিশোর ও তরুন-তরুনীরা এ সময়টাতে মোবাইল নির্ভর হয়ে পড়ে। স্কুল, কলেজ, লাইব্রেরী বন্ধ থাকায় বইয়ের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়ায় এমনটা হয়েছে বলে মনে করেন সচেতন মহল। তাদের মতে, এ সময়টাতে একটি বই-ই পারে একাকিত্ব ঘোঁচাতে। আর বই মানুষের জ্ঞানের পরিধিও বাড়ায়। একটি ভালো বই মানুষের ঘুমন্ত বিবেক জাগিয়ে তোলে। বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রভাবে দীর্ঘদিন বন্ধ হয়ে যায় বরিশাল বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারটি।


এছাড়া পাঠকের বইয়ের চাহিদা মেটানো বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমান বইয়ের লাইব্রেরীর কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায় করোনার কারণে। করোনার মধ্যে বইপ্রেমী পাঠকদের জন্য অনলাইনের মাধ্যমে বই পড়া কার্যক্রম চালু করে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র। তবে আশানুরূপ পাঠক পাওয়া যায়নি। করোনার প্রভাব কমতে শুরু করলে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সম্প্রতি বিভাগীয় গণগ্রন্থাগার ও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী কার্যক্রম শুরু করেছেন। বিভাগীয় গণগ্রন্থাগার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পূর্বের মতোই পাঠকরা লাইব্রেরীতে আসতে শুরু করেছেন। গত দুই মাসে প্রায় ৫ হাজারের মতো পাঠক গ্রন্থাগারে এসেছেন। পাঠকদের আনাগোনায় যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে বরিশাল বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারটি।


বরিশাল বিভাগীয় সরকারি গণগ্রন্থাগার সূত্রে জানা গেছে, বিভাগের সর্বস্তরের জনসাধারণকে বিজ্ঞান ও আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক সুবিধা সম্বলিত সময় সাশ্রয়ী পাঠকসেবা ও তথ্যসেবা প্রদানের মাধ্যমে জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় বিকশিত ও সমৃদ্ধকরণের লক্ষ্য নিয়ে ২০০৬ সালে নগরীর বিএম কলেজ সংলগ্ন বরিশাল বিভাগীয় সরকারি গণগ্রন্থাগারটি চালু করা হয়। এ পর্যন্ত গ্রন্থাগারটিতে ৮২ হাজার বই সংগ্রহে রয়েছে। সম্প্রতি লাইব্রেরীতে আরো যুক্ত হয়েছে ২৪শ নতুন বই। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নোবেল বিজয়ীদের ইতিহাস, বুদ্ধিজীবী হত্যা ও তার বিচার, মুসলিম মুদ্রা ও হস্তলিখন শিল্প, ভ্রমনে পৃথিবী দেখা ইত্যাদি। এছাড়াও গ্রন্থাগারটিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্ণার, জবস্ কর্ণার, হাই স্পিড সিকিউর ইন্টারনেট ও কম্পিউটার কর্ণার। যেখানে শিশুদের জন্য রয়েছে নানান গল্প, কবিতা ও জ্ঞানভিত্তিক বই। এখানে রয়েছে স্বল্পমূল্যে ১৫০ আসন বিশিষ্ট এসি সুবিধাসম্পন্ন বিশাল হল রুম। যেখানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সভা, সেমিনার, চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে পারেন। পুরো দিনের জন্য মাত্র ১২শ টাকা এবং অর্ধেক দিনের জন্য মাত্র ৮শ টাকায় হলরুমটি ভাড়া নেয়া যায়। 



জানা গেছে, শুরুতে পাঠকের আনাগোনা কম থাকলেও আস্তে আস্তে পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেশ জাকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠে গণগ্রন্থাগারটি। তবে বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে সরকারি এ গণগ্রন্থাগারটি বন্ধ হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বইপ্রেমীরা। বইয়ের সেলফগুলোতে গল্প, উপন্যাস, কবিতা সহ বিভিন্ন ধরনের দেশ-বিদেশের নামী-দামী লেখকদের সাড়ি সাড়ি আলোকিত বই থাকলেও পাঠকশূণ্য হয়ে পড়ে চেয়ার-টেবিলগুলো। জবস্ কর্ণারে বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার ফাইলগুলো পড়ে থাকলেও তা যেন ঝকঝকে অবস্থায় রয়েছে পাঠকের অভাবে। বছরের অন্যান্য সময় সাধারণ বেকার তরুন-তরুনী, যুবক-যুবতীদের উপস্থিতি বেশি থাকলেও সরকারি নির্দেশনা মেনে তারাও এখন গণগ্রন্থাগারে আসছেন না। যদিও পূর্বের তুলনায় পাঠক সমাগম বাড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন গ্রন্থাগার সংশ্লিষ্টরা। এদিকে গণগ্রন্থাগারে একটি সু-বিশাল হলরুম রয়েছে। যেখানে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি পালনের জন্য ব্যবহার করা যায়। সেক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ফি পরিশোধ করতে হবে।


এদিকে এখানে প্রচুর সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্বেও বরিশাল বিভাগীয় সরকারি গ্রণগ্রন্থাগারটি প্রচার প্রচারণায় ঘাটতি থাকায় পাঠক সংখ্যা খুব একটি বাড়েনি যুগ পেরিয়ে গেলেও। গ্রন্থাগার সূত্রে জানা গেছে, গড়ে প্রতিদিন গড়ে ৫শ’ এর মতো পাঠক এখানে আসা-যাওয়া করতেন। তবে বাস্তবে পাঠক সংখ্যা আরো কম। কেননা, কোন পাঠক যদি তিনটি ফ্লোরে গিয়ে পত্রিকা, বই ও কম্পিউটার ব্যবহার করেন সেক্ষেত্রে একজন পাঠককেই তিনজন হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। জানা গেছে, ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী পাঠকের সংখ্যাই বেশি। সরকার অনুমোদিত কর্মকর্তা কর্মচারীর ২৩টি পদ থাকলেও মাত্র ১২জন কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে এ গণগ্রন্থাগারটি চলছে।


অপরদিকে বৈশ্বিক মহামারী করোনার মধ্যে “আলোকিত মানুষ চাই” ব্যানারে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমান লাইব্রেরীগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। তবে পাঠকদের চাহিদার কথা ভেবে অনলাইনে বই পড়া কার্যক্রম হাতে নেয় বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র। কিন্তু ইন্টারনেটে ধীরগতি ও সহজলভ্যতা না থাকায় আশানুরূপ পাঠকের সাড়া পাননি তারা। অবশ্য বরিশালে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সম্প্রতি পাঠকের কাছে যাওয়া শুরু করেছে বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রের ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী। 


বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্র সমন্বয়কারী বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিষ্ট্রার বাহাউদ্দিন গোলাপ জানিয়েছেন, বরিশালে শুরু থেকে তিনি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি বলেন, পাঠকরা যাতে বইপড়া থেকে বঞ্চিত না হয়, পাঠকদের বই পড়া চর্চা কার্যক্রম অনলাইনের মাধ্যমে শুরু করেছিলাম। সকল পাঠকের এ্যন্ড্রওয়েড মোবাইল না থাকা, ইন্টারনেটের ধীরগতি ও সহজলভ্যতা না থাকায় এবং বই হাতে নিয়ে পড়ার মধ্যে যে আত্মতৃপ্তি তা অনলাইনে না হওয়ায় অনলাইন সেবাটি সফল হয়নি বলেন তিনি। স্কুল-কলেজভিত্তিক বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রম চলার কারণে পাঠকদের মধ্যে কিশোর ও তরুনদের সংখ্যাই বেশি বলেও জানান তিনি। তবে করোনার প্রকোপ কমতে শুরু করায় আগের মতোই রুটিন মোতাবেক ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী পাঠকদের কাছে যাচ্ছে।


বরিশাল বিভাগীয় সরকারি গণগ্রন্থাগারের সহকারি পরিচালক খালিদ মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ জানিয়েছেন, গ্রন্থাগারটিতে বেশকিছু সংস্কার করা হয়েছে। বিশেষ করে পাঠকদের জন্য সার্বক্ষণিক অনলাইন সেবা, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, নামাজের ব্যবস্থা, লাঞ্চ রুম ও ১০ এমপিপিএস স্পিডের নিরাপদ ইন্টারনেট সুবিধা। এছাড়া গণগ্রন্থাগারে পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বেশকিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন তারা। যেমন: বিভিন্ন জাতীয় দিবস রচনা, চিত্রাংকনসহ সৃজনশীল প্রতিযোগিতা আয়োজন। এছাড়া আগামী মাস থেকে প্রতি মাসের প্রথম রবিবার চাকুরী প্রত্যাশীদের জন্য কারিয়ার গাইড শেসন চালু হতে যাচ্ছে বলেন তিনি। শিশু, কিশোর, তরুন-তরুনী ও যুব শ্রেনীর পাঠকের সংখ্যা বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বরিশালে সিটিজেন নাগরিকদের গণগ্রন্থাগারে যাতায়াত কম। তিনি বলেন, “বই হতাশাগ্রস্ত কিংবা বিভ্রান্ত মানুষকে জীবনের মহৎ প্রাঙ্গণে পৌঁছে দিতে পারে। বই আমাদের আশা জাগায়, স্বপ্ন দেখায় এবং জীবনের সঠিক পথের নির্দেশনা দেয়। বই মানুষের মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করে। বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েই মানুষ গড়ে তুলতে পারে উন্নত ও আনন্দপূর্ণ আদর্শ জীবন। এজন্য তিনি বরিশালে সকল বয়সী বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষকে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে গণগ্রন্থাগারে আসার আহবান জানান। গণগ্রন্থাগারের আয়োজনে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও গণগ্রন্থাগার সম্পর্কে যে কোন তথ্য পেতে ভিজিট করুন: publiclibrary.barsaldiv.gov.bd