বাঙালী সংস্কৃতিতে হারিয়ে যাচ্ছে সম্প্রীতির ঈদকার্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক
এইচ.এম.এ রাতুল, জেলা প্রতিনিধি, বরিশাল।
প্রকাশিত: সোমবার ২রা মে ২০২২ ০৭:০০ অপরাহ্ন
বাঙালী সংস্কৃতিতে হারিয়ে যাচ্ছে সম্প্রীতির ঈদকার্ড

আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি যুগে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব, এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে পিছিয়ে যাচ্ছে শিল্প সংস্কৃতি। একটা সময় বাঙালী সংস্কৃতিতে ঈদ কার্ডের প্রচলন ছিল। আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার নাম ছিল ঈদ কার্ড। শুধুমাত্র ঈদের সময়ই নয়, নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়েও ব্যাপক প্রচলন ছিল কার্ডের। যার স্থান দখল করে নিয়েছে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমু। ফলে বর্তমান প্রজন্মের কাছে ঈদ কার্ডের পরিচিতি বা ব্যবহার কোনটি-ই নেই। তবে মেসেঞ্জার কিংবা হোয়াটঅ্যাপে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগাতে পারেনা বলে মনে করেন সুশীল সমাজ। তাদের মতে তথ্য প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার এবং বাঙালী সংস্কৃতির সমন্বয়ে পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্য সম্প্রীতি বাড়ানো যেতে পারে। 


ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয়  উৎসব ও আনন্দের দিন পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য ধনী-গরীব, ছোট-বড় সকল শ্রেণী পেশার মানুষ ভেদাভেদ ভুলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকে। এক সময় দেখা যেত ঈদ এলেই ভাই বোন আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয়জনকে ঈদ কার্ড দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করা হতো। প্রিয়জনদের কাছ থেকে ঈদ কার্ড পাওয়ার প্রতীক্ষায় থাকতেন অনেকেই। বর্তমান সময়ে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, এসএমএস সহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের কারণে বিলুপ্তির পথে ঈদ কার্ড। ৮০ থেকে ৯০ দশক এমনকি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেও ঈদ কার্ডের প্রচলন ছিল। ঈদ কার্ড ছিল আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার নাম। ঈদ কার্ড ছাড়া ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করাটা যেন চিন্তাই করা যেতো না। কার্ডগুলোতে শোভা পেত মসজিদ, কাবা শরীফ, মদিনা শরীফ, ফুল, তারকা ও পাখিসহ নানা ছবি। সেই সময় রমজান এলে জমে উঠতো ঈদ কার্ডের বাজার। গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তৃতির কারণে ইতিহাস ঐতিহ্য হারাতে বসেছে ঈদ কার্ড। আর ছাপাখানা ও কার্ডের দোকানগুলোতেও এখন আর ঈদ কার্ড পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, টুইটার, ই-মেইল, ফেসবুক, ই-কার্ড, এসএমএস, এমএমএসসহ বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেই ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের কাজ সেরে নিচ্ছেন সবাই। 


উদীয়মান সংবাদকর্মী তন্ময় তপু এ বিষয়ে বলেন, বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির বিস্তৃতি বাড়ায় মানুষের মধ্যে আন্তরিকতার ঘাটতি তৈরী হচ্ছে। শুভেচ্ছা বিনিময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অনেকেই এখন যে যার স্থান থেকে দায়িত্ব শেষ করে মাত্র।


তরুন কবি, লেখক ও সাংবাদিক সৈয়দ মেহেদী হাসান বলেন, তথ্য প্রযুক্তির প্রভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছে অতীত শিল্প সাহিত্য। আধুনিকতার নামে মূলত জাতিগত অবক্ষয়ের কারণে শিল্প সাহিত্য হারিয়ে যাচ্ছে। বাঙালী পরস্পর ভাব বিনিময়ে যে প্রচলন ছিল এবং কার্ড বিনিময়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতা সৃষ্টি হতো এখনকার প্রজন্ম তা ভুলতে বসেছে।


প্রবীন সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব ও সাংবাদিক এ্যাড. এসএম ইকবাল হোসেন বলেন, একটা সময় ঈদ কার্ড বিনিময় হৃদ্ধতার পরিচয় দিতো। মানুষ আগ্রহ ভরে বইয়ের দোকানে গিয়ে রং-বেরংয়ের ঈদ কার্ড কিনে প্রিয়জনের মধ্যে তা বিলি করতো। আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষে মানুষে আন্তরিকতা কমে গেছে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার প্রচলন আছে। এ থেকে ফিরে আসলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে পুরণো সংস্কৃতি ফিরে আসবে।


বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য প্রফেসর ড. ছাদেকুল আরেফীন বলেন, ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে ঈদ কার্ডের যেমন গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি আধুনিক তথ্য প্রযুক্তিরও গুরুত্ব রয়েছে। ঈদ কার্ড বিনিময় মানুষের মধ্যে একটি আবেদন সৃষ্টি করতো। আর তথ্য প্রযুক্তির কারণে মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই শিল্প সংস্কৃতি ও তথ্য প্রযুক্তি উভয়ের সমন্বয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিতে সামাজিক সম্প্রীতি বাড়ানো সম্ভব। তাহলেই তরুন প্রজন্মের মধ্যে ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সম্প্রীতি গতিশীল হবে।