বরিশালে ঢিলেঢালা লকডাউন, চলছে লুকোচুরি !
এম.কে. রানা, বরিশাল ॥
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারঘোষিত কঠোর লকডাউনের পঞ্চম দিন আজ রবিবার (১৮ এপ্রিল)। গত ১৪ এপ্রিল থেকে সারাদেশে চলছে ৮ দিনের লকডাউন। লকডাউনের পঞ্চম দিনে বরিশালে অনেকটা ঢিলে-ঢালাভাবে চলছে।
তবে পুলিশের সামনেই নগরীর ব্যস্ততম এলাকাসহ পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকান, কাঁচাবাজার, হার্ডওয়্যার, কাপড় ও রাস্তায় সাধারণ মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। বেশিরভাগ মানুষকেই মানতে দেখা যায়নি স্বাস্থ্যবিধি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকায় বাস চলাচল না করলেও গণ পরিবহণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মাহিন্দ্রা, সিএনজি, ইজিবাইকসহ থ্রি হুইলার, ইট-বালু বোঝাই ট্রাক দেদারছে চলাচল করছে। রবিবার (১৮এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এয়ারপোর্ট থানাধীন কাশিপুর গার্লস স্কুলের সামনে ইটবোঝাই ট্রাকের চাপায় মালেক নামে একজন ভিক্ষুকের মৃত্যু হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে প্রশাসন ও স্থানীয় প্রভাবশালী দলের নেতাকর্মীদের ম্যানেজ করে সিএনজি, ইজিবাইক, থ্রি হুইলার ও ইট-বালুর ট্রাকসহ এসকল যানবাহন চলছে। যদিও পুলিশের দাবী হয়তোবা উন্নয়ন কাজের জন্যই ইট-বালুর ট্রাকগুলো চলাচল করছে। তবে সরেজমিনে পুলিশের কোন চেকপোষ্টে ট্রাক থামাতে দেখা যায়নি।
লকডাউনের মধ্যে ইট-বালু ট্রাক কিভাবে চলাচল করতে জানতে চাইলে দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত এয়ারপোর্ট থানার ওসি (তদন্ত) ফয়সাল এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।
সরেজমিনে বরিশাল নগরীর রুপাতলী, বাংলাবাজার, নতুনবাজার, নথুল্লাবাদ, কাটপট্টি, কাউনিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লকডাউন উপেক্ষা করে চায়ের দোকান, ইলেকট্রিক দোকান, হার্ডওয়্যার, কাপড়ের দোকানসহ যেগুলো লকডাউনে খোলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেগুলোও খুলে বেচাকেনা চলছে। এছাড়া কাচাঁবাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান গুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মানুষ।
কাচাঁবাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে দোকানগুলো থেকে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের সময় ক্রেতা-বিক্রেতা কারো মাঝেই তেমন সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়নি। অবশ্য ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনলেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। আর তারা চলে গেলে যেই সেই আগের অবস্থা হয়ে যায়।
কামরুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, লকডাউনের মধ্যে দোকানপাট বন্ধ থাকলেও মাস শেষে দোকানভাড়া ঠিকই দিতে হবে। তাই তিনি দোকান খুলেছেন। আরেক দোকানী মতিউর বলেন, করোনার কারণে এমনিতেই ব্যবসা বাণিজ্য মন্দা। তার উপর লকডাউন দেয়ায় তিনি তার ব্যবসা নিয়ে চিন্তিত। তারা দাবী সরকার যেন দোকানভাড়ার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
সহকারী পুলিশ কমিশনার (এয়ারপোর্ট) মাসুদ রানা বলেন, লকডাউনে সরকারের দেয়া নির্দেশনা মেনে চলার জন্য লকডাউনের পূর্ব থেকেই পুলিশের পক্ষ থেকে প্রচারণা চলছে।
ইট-বালুর ট্রাকের বিষয়ে তিনি বলেন, হয়তো উন্নয়ন কাজের জন্য ট্রাকগুলোতে ইট-বালু নেয়া হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইট-বালু বোঝাই ট্রাকগুলো থামিয়ে যাচাই করা হচ্ছে।
এদিকে নগরীর একাধিক স্থানে পুলিশের চেকপোষ্ট চলাকালে দেখা গেছে, ব্যাক্তিগত মোটরসাইকেল নিয়ে অসংখ্য মানুষ রাস্তায় বের হয়েছে এবং নানা অজুহাত দেখিয়ে তারা চেকপোষ্ট অতিক্রম করছে।
অপরদিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) লকডাউনের মধ্যে জরুরী প্রয়োজনে বের হলে মুভমেন্ট পাস কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছেন। যেখানে জরুরীর আওতার বাহিরে চলাচলকারীদের মুভমেন্ট পাস সংগ্রহ করার নির্দেশনা দেয়া আছে।
তবে বরিশালে পুলিশের কোন চেকপোষ্টে দায়িত্বরতদের ব্যাক্তিগত মোটর সাইকেল বা গাড়ি নিয়ে বের হওয়া মানুষের মুভমেন্ট পাস আছে কিনা তা যাচাই করতে দেখা যায়নি।
ট্রাফিক সার্জেন্ট রফিকুল ইসলাম জানান, রাস্তায় বের হওয়া গাড়িগুলো পুলিশ তল্লাশি করছে। বিনা প্রয়োজনে কেউ বের হলে গাড়িগুলো ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেউ মাস্ক না পরলে পরার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
এদিকে লকডাউনের প্রথম দিনেই করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে বরিশাল মেট্রপলিটন পুলিশ কমিশনার মোঃ শাহাবুদ্দিন খান এক ভিডিও বার্তার মাধ্যমে সাধারন জনগনকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহায়তা করার জন্য বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছেন। এছাড়া সকল পুলিশ সদস্যকে কঠোরভাবে লকডাউন কার্যকরে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোঃ শাহাবুদ্দিন খান (বিপিএম-বার) মুঠোফোনে বলেন, সাধারণ মানুষ সচেতন না হলে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে করোনার সংক্রমন ঠেকানো যাবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লকডাউন কার্যকর করতে সরকারের যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।
এদিকে লকডাউন কার্যকর ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে বরিশাল জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটগণ ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করছেন এবং অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অর্থদন্ড দিয়েছেন। তবুও উপেক্ষিত হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি, মানা হচ্ছেনা লকডাউন। এ বিষয়ে জানতে বরিশাল জেলা প্রশাসকের মুঠোফোনে কল দেয়া হলেও তিনি তা রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য গত কয়েকদিনের স্বাস্থ্যবিভাগের দেয়া তথ্যমতে, বরিশালে করোনা সংক্রমনের হার প্রায় ৪০ শতাংশ। গত এক সপ্তাহে বরিশালে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে বরিশাল নগরীতেই করোনা সংক্রমনের হার বেশি। এ পর্যন্ত বিভাগে করোনায় ২৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বিভাগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন বরিশাল জেলায়। মৃত্যুবরণকারী ২৪২ জনের মধ্যে বরিশাল জেলায় সর্বোচ্চ ১০৩ জন, এরপর পটুয়াখালীতে ৪৭ জন, পিরোজপুরে ২৯ জন, ঝালকাঠিতে ২৩ জন, বরগুনায় ২২ জন এবং ভোলায় ১৮ জন।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ বাসুদেব কুমার দাস সকলকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলাচলের জন্য আহবান জানিয়ে বলেন, করোনার প্রথম ঢেউয়ে বরিশাল বিভাগে সংক্রমনের হার কম ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমনের হার বেশি। এই অবস্থায় শুধু করোনার টিকা গ্রহণ করলেই চলবে না স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।