১৭ বছর ধরে হচ্ছে বইমেলা যে গ্রামে !

নিজস্ব প্রতিবেদক
ফুয়াদ হাসান রঞ্জু, উপজেলা প্রতিনিধি, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল
প্রকাশিত: মঙ্গলবার ২২শে ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৬:০০ অপরাহ্ন
১৭ বছর ধরে হচ্ছে বইমেলা যে গ্রামে !

যমুনার কোলঘেষা একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। এ গ্রামের বইপ্রেমী তরুণ-তরুণী-যুবকরা মিলে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে বই মেলার আয়োজন করে আসছে। এক বা দুই দিন নয়, টানা তিন দিন ধরে চলে এ মেলা। দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন কবি, লেখক ও বইপ্রেমীরা। সঙ্গে যুক্ত হন গ্রামের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষও।


ফলে, বইমেলায় বাংলা ভাষা চর্চার পাশাপাশি দেশবরণ্য ব্যক্তিদের বিষয়ে জানতে পারছেন গ্রামের মানুষ।


বলছি, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার অর্জুনা ইউনিয়নের অর্জুনা নামে প্রত্যন্ত এক গ্রামের কথা।


গ্রামটিতে প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহিদ দিবস উপলক্ষে টানা ৩ দিনব্যাপী বইমেলার আয়োজন করা হয়।


অর্জুনা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী হাজী ইসমাইল খাঁ কারিগরি কলেজ মাঠ প্রাঙ্গণে এ মেলার আয়োজন করেন স্থানীয় অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগার।


মেলার আগের দিন রাতে ১২টা ১ মিনিটে কলেজের শহিদ মিনারে শহিদদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়।


সূর্য ওঠার আগেই গ্রামের শিশু থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি পেশার মানুষ কলেজ প্রাঙ্গণে নির্মিত শহিদ বেদীতে ফুলেল শুভেচ্ছা ও পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, জনপ্রতিনিধি ও গ্রামের কোমলমতি শিশুসহ বয়োজ্যেষ্ঠদের অংশগ্রহণে জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে।


বইমেলার উদ্বোধন করেন- হাজী ইসমাইল খাঁ কারিগরি কলেজের অধ্যক্ষ, গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বপ্নদ্রষ্টা আবদুস ছাত্তার খান বাবু।


মেলা উদ্বোধনের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মেলাজুড়ে ছোট-বড় ১০টি স্টল। সেখানে কবি-লেখকের বইয়ের পসরা সাজানো। মেলায় তরুণ-তরুণীদের পাশাপাশি শিশু-কিশোররাও এসেছে।



মেলার আয়োজক অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগার সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সাল থেকে টানা ১৭ বছর ধরে এ মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। মেলার শুরুতে কারও তেমন সহযোগিতা না পেলেও ধীরে ধীরে মানুষের সহযোগিতা বাড়ছে। তবে এ মেলায় যে শুধু বই-ই বিক্রি হয় তা নয়, মাটির তৈরি নানা ধরনের পণ্য সামগ্রী, বাঁশ-বেতের পণ্য, খাবারের দোকান, খেলনা, নাগরদোলার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।


শুধু তাই নয়, মেলা উপলক্ষে ছড়া, কবিতা, রচনা, গল্প ও গানের প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়।


এবারের বইমেলায় ১০টি স্টল অংশ গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে টাঙ্গাইল পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক কবি মাহমুদ কামালের সাধারণ গ্রন্থাগার, জয় বাংলা পাঠাগার, ভালোবাসার শূন্যতা, হাজী ইসমাইল খাঁ কলেজ, প্রসূতি, বাঁশি, সৌখিন নার্সারি, ভূঞাপুর ব্লাড ব্যাংক, গোল্ডেন মানে চুমুক, র‌্যামন নিকেতন।


বইমেলায় আসা ৫ম শ্রেণিতে পড়ুয়া সুমাইয়া আক্তার তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, “বইমেলা আমার খুব ভালো লাগে। তাই এসেছি। ছড়া ও গল্পের বই কিনবো।”


৭ম শ্রেণির ছাত্রী রাইসা খাতুন তার অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেন, “শহরের বইমেলায় আমরা যেতে পারি না। তবে, শহরের বইমেলার অভাব পূরণ হচ্ছে আমাদের গ্রামের বইমেলা থেকে।”


সহপাঠীরা মিলে বইমেলায় এসেছে স্থানীয় শিক্ষার্থী সেতু খন্দকার, জেসমিন চৌধুরী, রিতু খাতুন ও রচিয়তা আক্তার। সহপাঠীরা মিলে মেলা থেকে ১০-১২টি বই কিনেছে তারা।


তবে তারা তিনদিন নয়, সপ্তাহব্যাপী বইমেলার আয়োজনের পক্ষে তাদের অভিমত দিয়েছেন।


জয় বাংলা স্টলের সোহাগ বলেন, “এ গ্রামে প্রতিবছর বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় শুনে এবার প্রথমবারের মতো আমরা স্টল দিয়েছি। শিশু-কিশোরদের পদচারণায় মেলা প্রাঙ্গণ মুখরিত। প্রতিদিন শিশু-কিশোরদের ছড়া, কবিতা ও মুক্তিযুদ্ধের বই বেশি বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ভাষা শহিদদের নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইও বিক্রি হচ্ছে।”


মেলা বিষয়ে অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগারের সভাপতি অমিত হাসান (অনন্ত) এবং রাকিব খান সাধারণ সম্পাদক জানান, অর্জুনা গ্রামটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। অর্জুনা হাজী ইসমাইল খাঁ কারিগরি কলেজ মাঠে অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগারের উদ্যোগে প্রতিবছর অমর একুশে বইমেলার আয়োজন করা হয়। তিন দিনব্যাপী এ বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামের লোকজন ছাড়াও দূর-দূরান্তের মানুষ এতে অংশ নেন। লেখকরাও আসেন। সুন্দর পরিবেশে মেলা হয়। মেলার মাধ্যমে বাংলা ভাষার চর্চা ও দেশপ্রেমসহ ৫২’র ভাষা আন্দোলনে শহিদদের বিষয়েও জানতে পারছে সাধারণ মানুষ।”


এদিকে, হাজী ইসমাইল খাঁ কারিগরি কলেজের অধ্যক্ষ ও গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা আবদুস ছাত্তার খান বাবু বলেন, “আমি যখন ঢাকা কলেজে লেখাপড়া করি তখন ঢাকায় বইমেলা দেখে আমার মনে গ্রাম-অঞ্চলে বইমেলার স্বপ্ন জাগে। এরই অংশ হিসেবে ২০০৬ সাল থেকে টানা ১৭ বছর ধরে প্রত্যন্ত গ্রাম-অঞ্চলে বইমেলার আয়োজন করে আসছি। প্রথম দিকে গ্রামের মানুষদের তেমন কোনো সমর্থন না পেলেও বর্তমানে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।”

তিনি আরও বলেন “এ ছাড়া মেলায় বিভিন্ন সময়ে দেশবরণ্য ব্যক্তিদের আগমনে উৎসবমুখর হয়েছে।