বিদেশ যাচ্ছে বরিশালের পান, ভুমিকা রাখতে পারে জিডিপিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক
এইচ.এম.এ রাতুল, জেলা প্রতিনিধি, বরিশাল।
প্রকাশিত: সোমবার ২২শে এপ্রিল ২০২৪ ০৪:৪৯ অপরাহ্ন
বিদেশ যাচ্ছে বরিশালের পান, ভুমিকা রাখতে পারে জিডিপিতে

পান চাষের ভরা মৌসুমে ব্যস্ত সময় পার করছেন বরিশালের পান চাষীরা। পাশাপাশি পান ব্যবসায়ীরাও এখন ছুটছেন পান চাষীদের কাছে। এ অঞ্চলের পান অনেক সুস্বাদু হওয়ায় দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও যাচ্ছে। বিদেশে রপ্তানীর সুযোগ থাকায় এ খাত থেকে অর্জিত একটি বড় অংশ অর্থনৈতিকভাবে জিডিপিতে যুক্ত হতে পারে বলে মনে করেন বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তবে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিয়ে পান রপ্তানী না করলে লাভের চেয়ে লোকসানের ঝুঁকি বেশি থাকে বলেন তারা। 


এদিকে মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হলেও স্থানীয় পান চাষীদের অভিযোগ তারা পানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এমনকি কৃষি কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও পাচ্ছেন না কোন সহযোগিতা কিংবা পরামর্শ। আর কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, সুনির্দিষ্ট প্রকল্প না  থাকায় চাষীদের আর্থিক সহযোগিতা কিংবা প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। তবে তারা কৃষকদের পান চাষে সফল হওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত কৃষি পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলে দাবি তাদের।


সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, পানের বরজগুলোতে চলছে পরিচর্যার কাজ। পান চাষিরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। অনেকে আবার বরজ সংস্কার কাজেও ব্যস্ত। বাঁশ ও বাঁশের শলা দিয়ে মাচা তৈরি করে খড়-কুটা দিয়ে ছাউনি করে সুপারি গাছের পাতা ও কলা পাতা দিয়ে ঘিরে তৈরি করা হচ্ছে পানের বরজ। 


উজিরপুর উপজেলার পূর্ব মুন্ডপাশা গ্রামের পানচাষী সাহেব আলী আকন বলেন, পূর্ব পুরুষদের আমল থেকেই তিনি পান চাষ করছেন। তবে গত কয়েক বছর ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে তার বরজ সংখ্যা কমেছে। বর্তমানে ১৫ শতাংশ জমিতে তার ৩০০ বরজ রয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, কৃষি অফিস থেকে তাদেরকে কোন সহযোগিতা কিংবা পরামর্শ দেয়া হয় না।


আরেক পান চাষি মিলন খলিফা বলেন, বিভিন্ন ধরণের কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা কমে গেছে। তাই ধান, গম, তিলসহ অন্যান্য ফসল এখন তেমন একটা উৎপাদন হচ্ছে না। তাই পানে চাষে ঝুঁকছেন তিনি। ভালভাবে যতœ করলে পানের উৎপাদনও বেশি হয়। প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ বেশী হলেও একটি বরজ করলে একটানা ১৫-২০ বছর পান বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করা সম্ভব বলেও জানান তিনি। যদিও অতি বর্ষন, ঘূর্ণিঝড় এবং টর্ণেডো ছাড়াও বড় ধরনের বন্যার হাত থেকে পান বরজ রক্ষা কঠিন কাজ। তবে স্বল্প জমিতে পান চাষ করে অধিক লাভবান হওয়া যায় বলে তারা এখন পানকে ‘টাকার গাছ’ হিসাবে উপাধি দিয়েছেন।


গৌরনদী উপজেলার শরিকল গ্রামের পানছাষী বিপ্লব ঢালী বলেন, ৩০ শতাংশ জমিতে তার প্রায় ৬০০ পানের বরজ রয়েছে। গত বছর ভাল উৎপাদন হওয়ায় এবার বরজের সংখ্যা বাড়িয়েছেন তিনি। অতিরিক্ত গরম পড়লে বরজে পানি  দিতে হয়। এতে তাদের পরিশ্রম  এবং অর্থ দুটোই বেশি খরচ হয়। কিন্তু সে অনুযায়ী পানের মূল্য তারা পান না বলেন তিনি।  


টরকী বন্দরের পানের আড়ৎদার রমনী সোম বলেন, বৈশাখ থেকে আশি^ন-কার্তিক মাস পর্যন্ত পানের ভরা মৌসুম। এ সময়ে নিলামের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পান ব্যবসায়ীরা পান কিনে নেয়। ঢাকার ব্যবসায়ীরা এ অঞ্চল থেকে পান নিয়ে সৌদিআরব,  দুবাই, আবুধাবী, সুইজারল্যান্ডসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে পান রপ্তানী করছেন। তবে বর্তমানে এক শ্রেনীর অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন হাটবাজার থেকে পান সংগ্রহ করে বিদেশে পাঠাচ্ছেন দাবী করে তিনি বলেন, এতে একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পানচাষীরা। অপরদিকে পানের গুণগত মান ঠিক না থাকায় বিশে^ দেশের পানের সুনাম ক্ষুন্ন হওয়ার আশংকা রয়েছে। 


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রায় ৭ হাজার হেক্টর জমিতে পানের বরজ রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে জেলার ১০ উপজেলায় ২১ হাজার ১৬ মেট্রিকটন পান উৎপাদন হয়েছে। যার মূল্য প্রায় ১শ’ কোটি টাকারও বেশি। পান ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশ থেকে যে পরিমান পান বিদেশে রপ্তানী হচ্ছে, তার সিংহভাগ যাচ্ছে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে।


জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরে বরিশাল জেলার ১০ উপজেলায় ২ হাজার ৯৬০ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল সদর উপজেলায় ৫০ হেক্টর, বাবুগঞ্জ উপজেলায় ১৩৫ হেক্টর, উজিরপুর উপজেলায় ৩১৮ হেক্টর, বাকেরগঞ্জ উপজেলায় ৫৫০ হেক্টর, গৌরনদী উপজেলায় ১ হাজার ৫০ হেক্টর, আগৈলঝাড়ায় উপজেলায় ২৪০ হেক্টর, মুলাদি উপজেলায় ১৫২ হেক্টর, হিজলা উপজেলায় ১৬০ হেক্টর, মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় ২০০ হেক্টর, বানারীপাড়া উপজেলায় ১০৫ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়।


খামারবাড়ির সূত্রে আরও জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে বরিশাল সদর উপজেলায় ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ৩৭৫ মেট্রিকটন, বাবুগঞ্জে ৬ দশমিক ৬.৮০ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ৯১৮ মেট্রিকটন, উজিরপুরে ৮ দশমিক ০ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ৫৪৪ মেট্রিকটন, বাকেরগঞ্জে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ৩ হাজার ৯৬০ মেট্রিকটন, গৌরনদীতে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ৭ হাজার ৮৭ মেট্রিকটন, আগৈলঝাড়ায় ৭ দশমিক ০ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৬৮০ মেট্রিকটন, মুলাদিতে ৮ দশমিক ০ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ২১৬ মেট্রিকটন, হিজলায় ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৪০ মেট্রিকটন, মেহেন্দিগঞ্জে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ হিসেবে পান উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন ও  বানারীপাড়া উপজেলায় ৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ হেক্টর প্রতি ৬৯৬ মেট্রিকটন পান উৎপাদন হয়।


সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের পান এখন মধ্যপ্রাচ্যের বাজার দখল করেছে। দেশ থেকে যে পরিমান পান রপ্তানী হচ্ছে, তার সিংহভাগই যাচ্ছে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে। তবে অনাদিকাল থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় পানের আবাদ হলেও এখনো তা খুব একটা আধুনিক প্রযুক্তি সুবিধা লাভ করেনি। লাভজনক ফসল হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মধ্যে ক্রমেই পান বরজের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। জলবায়ুগত কারনে বরিশালের পান বেশ সুস্বাদু হওয়ায় দেশÑবিদেশে এর চাহিদাও যথেষ্ঠ। বিগত কয়েক বছর ধরে পাকিস্তানে বরিশালের পান রপ্তানি হলেও এখন তা মধ্যপ্রাচ্যের বাজারও দখল করছে। রপ্তানিকারকগণ পান কিনে আকাশপথে বিশেষ ব্যবস্থায় বিদেশে রপ্তানী করছে। 


উজিরপুর উপজেলা কৃষি অফিসার কপিল বিশ^াস বলেন, বর্তমান পানভিত্তিক কোন  প্রকল্প না  থাকায় চাষীদের আর্থিক সহযোগিতা কিংবা প্রশিক্ষণ দেয়া যাচ্ছেনা। তবে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ তাদের পক্ষ থেকে নিয়মিত পানচাষীসহ সকল চাষীকেই বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া কৃষি অফিসের পরামর্শ নিয়ে যে কোন ফসল চাষ করলে চাষীরা লাভবান হবে।


গৌরনদী উপজেলা কৃষি অফিসার মো. সেকান্দার শেখ বলেন, স্থানীয় পানচাষীদের প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করছেন তারা। যাতে পানের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং চাষীরা লাভবান হয়। তবে বরিশাল অঞ্চলের পান বিদেশে রপ্তানী হয় এ বিষয়ে তিনি অবগত নন বলে জানান।


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরিশালের উপপরিচালক মো. মুরাদুল হাসান জানান, পান চাষে কীটনাশক বা সার স্প্রে না করার জন্য পানচাষীদের বলা হয় এবং নিরাপদ পান উৎপাদনের জন্য তাদেরকে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হয়। তিনি বলেন, বর্তমানে সারাবছরই পানের চাহিদা রয়েছে এবং সঠিক দামও পাচ্ছেন পানচাষিরা। এ কারণে অনেক কৃষকই পান চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। তাছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের পান বিশে^র বিভিন্ন দেশে রপ্তানীর সুযোগ থাকায় এ থেকে অর্জিত একটি বড় অংশ অর্থনৈতিকভাবে জিডিপিতে যুক্ত হতে পারে বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা।