প্রকাশ: ৪ নভেম্বর ২০২১, ১৯:৫০
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র ভবিষ্যত কান্ডারী বর্তমানে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। যদিও তিনি লন্ডনে থেকে দলকে দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার কারাবরণ এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাহিরে থাকায় দেশের বিভিন্ন জেলায় কতিপয় নেতারা একক আধিপত্য চালিয়ে আসছিলেন। যেমনটি বরিশালেও ছিল। এখানে দলের নীতিমালা উপেক্ষা করে যুগ্ম মহাসচিব এ্যাড. মজিবর রহমান সরোয়ার একাধিক পদ দখলে রাখায় অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীরা কোনঠাসা হয়ে পড়েছিলেন।
সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বরিশালের বিভিন্ন শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে ভার্চুয়ালী যুক্ত ছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রায় সাড়ে ৩ ঘন্টার ওই বৈঠকে বরিশালের তিন কমিটির নেতাদের সাথে কথাও বলেন তারেক রহমান। ওই বৈঠকের পরপরই গুঞ্জন উঠেছিল বরিশাল বিএনপি’র রাজনীতিতে এ্যাড. মজিবর রহমান সরোয়ারের একক আধিপত্যের অবসান ঘটবে। গত বুধবার (৩ নভেম্বর) বরিশাল মহানগর, জেলা (উত্তর) ও জেলা (দক্ষিণ) কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই গুঞ্জনের অবসান ঘটলো।
সূত্রমতে, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বিএনপির রাজনীতিতে নাম লেখান এ্যাড. মজিবর রহমান সরোয়ার। এরপর বরিশাল জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি পদ বাগিয়ে নেন। ১৯৯০ সালে বরিশাল নগরীর কাউনিয়া টেক্সটাইল মিলে শ্রমিক নেতা সালামকে গুলি করে হত্যা মামলার প্রধান আসামি হয়ে আত্মগোপন করেন সরোয়ার। একই বছর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন হলে বরিশাল বিএনপিতে সরোয়ার-যুগের সূচনা হয়।
এরপরে আর পেছনে তাকাতে হয়নি সরোয়ারকে। গত ৩১ বছর যাবত বরিশাল বিএনপির রাজনীতিতে একক আধিপত্য বিস্তার করে দল পরিচালনা করেছেন তিনি। সংসদ সদস্য, জাতীয় সংসদের হুইপ, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, বরিশাল বিএনপির সভাপতি যখন যে পদ চেয়েছেন, সেটাই আদায় করেছেন। নিজে পদ নিয়েছেন এবং নিজ অনুসারীদের দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পদ। তার মতের বিরুদ্ধে গেলেই ঝুলত বহিস্কারের খরগ।
এমনকি নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে আলোচনায় আসা নেতাদেরকে তার পথের কাটা মনে করে সরিয়ে দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গত বুধবার বরিশাল মহানগর এবং উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে সেই আধিপত্যে ভাটা পড়লো। সরোয়ার এখন শুধু দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব।
রাজনৈতিক সূত্রমতে, ১৯৯১ সালে তৎকালীন বরিশাল-৩ (হিজলা-মুলাদী) আসনে দলের মনোনয়ন পেয়েও পাননি। তবে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে বরিশাল সদর (বরিশাল-৫) আসনের এমপি আবদুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি হলে শূন্য আসনের উপনির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন সরোয়ার। অবশ্য ‘৯৬-এর সংসদ নির্বাচনে সরোয়ার মনোনয়ন বঞ্চিত হলে সদরে এমপি নির্বাচিত হন রহমান বিশ্বাসের পুত্র নাসিম বিশ্বাস।
‘৯৮ সালের নভেম্বরে ডা. নাসিম বিশ্বাসের অকাল মৃত্যুর পর বরিশাল বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনে সরোয়ার বাধাহীন আধিপত্য গড়ে তোলেন, যা অটুট ছিল প্রায় দুই যুগ। ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী চারদলীয় জোট শাসনামলে সরোয়ার একইসঙ্গে সংসদ সদস্য, জাতীয় সংসদের হুইপ, জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে ছিলেন। এছাড়া অর্ধশতাধিক সংগঠনের সভাপতিও ছিলেন তিনি। দলে এক নেতা এক পদ নীতি অনেক আগে চালু হলেও সরোয়ার দলের যুগ্ম মহাসচিবের পাশাপাশি এতোদিন বরিশাল মহানগর সভাপতির পদও ধরে রেখেছিলেন।
সূত্রমতে, ২০০৩ সালে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচনে সরোয়ারের মনোনয়ন নিশ্চিত হলে সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামাল ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এবায়েদুল হক চাঁন বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় দল থেকে বহিস্কৃত হয়ে প্রায় আট বছর দলের বাইরে ছিলেন তারা।
২০১০ সালে এবায়েদুল হক চাঁন দক্ষিণ জেলায় পদ পেলেও দক্ষিণ ও উত্তর দুটি জেলা কমিটিই নিয়ন্ত্রণ করতেন সরোয়ার। আর আহসান হাবিব কামাল দলে ফিরলেও হারানো মহানগর সভাপতি পদ আর ফিরে পাননি। তিনি ২০১৩ সালে সিটি মেয়র নির্বাচিত হলেও দলে তার অবস্থান শক্তপোক্ত করতে পারেননি সরোয়ারের দাপটে। সরোয়ারের একক নেতৃত্বের কারণে কোণঠাসা হয়ে নব্বই দশকের ছাত্রদল নেত্রী বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস আক্তার শিরিন ঢাকায় গিয়ে কেন্দ্রের রাজনীতিতে জড়ান।
সরোয়ার অনুসারীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতের পর মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে একসময় সরোয়ারের আস্থাভাজন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম রাজন এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। এছাড়া বরিশাল নগরীর বাসিন্দা হয়েও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বরিশাল বিএনপিতে স্থায়ী অবস্থান নিতে পারেননি বলে গুঞ্জন রয়েছে।
এদিকে বিগত এক দশকে দলীয় বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচীতে তেমন একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব এ্যাড. মজিবর রহমান সরোয়ার। কারণ হিসেবে জানা গেছে, দলে তার একক আধিপত্যের কারণেই নেতাকর্মীরা এখন আর তার কাছে ঘেষেন না। এমনও শোনা গেছে, বিএনপির কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিতে তার অবস্থান জানান দিতে মহানগরের গ্রামাঞ্চলে গিয়ে গুটি কয়েক নেতাকর্মী নিয়ে ফটোশেসন করে তড়িঘড়ি করে স্থান ত্যাগ করেছেন সরোয়ার।
যার ধারাবাহিকতায় ঝিমিয়ে পড়া বরিশাল বিএনপিকে চাঙ্গা করতে বরিশাল মহানগরসহ তিনটি সাংগঠনিক কমিটি গঠনে শীর্ষ পদের জন্য স্থানীয় ১৮ নেতার তথ্য নেয় দলটির হাইকমান্ড। গত ১২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বরিশাল অঞ্চলের সাংগঠনিক নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল সভা করে শীর্ষ পদপ্রত্যাশী নেতাদের তথ্য সংগ্রহ করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। জানা গেছে, ওই বৈঠকে দলের কার্যক্রমে অসন্তোষ প্রকাশ করে দলের হাইকমান্ড। এমনকি দেশের অন্যান্য বিভাগের তুলনায় এ বিভাগে সাংগঠনিক কার্যক্রম অনেক পিছিয়ে কেন, তাও জানতে চেয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারমান। এমনকি দলীয় কোন্দলকে উস্কে দেয়ার জন্য দলের শীর্ষ নেতারা ক্ষোভও প্রকাশ করেন। এর পরপরই গুঞ্জন ওঠে বরিশাল বিএনপির রাজনীতিতে সরোয়ার যুগের অবসান হচ্ছে।
গত বুধবার (৩ নভেম্বর) কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ দফতর সম্পাদক মোহম্মদ মুনির হোসেন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বরিশাল মহানগর এবং দক্ষিণ ও উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠনের বিষয়টি প্রকাশের মধ্য দিয়ে সেই গুঞ্জনের অবসান হলো। কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরীন বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি মনিরুজ্জামান ফারুককে বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক করা হয়েছে। এ ছাড়া আইনজীবী আলী হায়দার বাবুল সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এবং সদস্য সচিব করা হয়েছে মহানগর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মীর জাহিদুল কবির জাহিদকে। দক্ষিণ জেলা কমিটিতে- সাবেক ছাত্রনেতা মজিবর রহমান নান্টুকে আহ্বায়ক এবং আকতার হোসেন মেবুলকে সদস্য সচিব হিসেবে রাখা হয়েছে। উত্তর জেলা কমিটিতে দেওয়ান মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে আহ্বায়ক এবং গৌরনদী পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান মুকুলকে সদস্য সচিব করা হয়েছে।
নবগঠিত তিন কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন- আলোচনায় থাকা দলের যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ার, দীর্ঘদিন সরকার বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া ৫৩ মামলার আসামি মহানগর বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জিয়া উদ্দীন সিকদার জিয়া, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবায়েদুল হক চাঁন ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম শাহীন, উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও এমপি মেজবাহউদ্দীন ফরহাদ এবং ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমানসহ অনেক নেতা।