ব্যস্ততা বেড়েছে নওগাঁর কামার পল্লীর কারিগরদের

নিজস্ব প্রতিবেদক
রিফাত হোসাইন সবুজ, জেলা প্রতিনিধি, নওগাঁ
প্রকাশিত: বুধবার ৬ই জুলাই ২০২২ ০৬:০০ অপরাহ্ন
ব্যস্ততা বেড়েছে নওগাঁর কামার পল্লীর কারিগরদের

মুসলিম জাহানের জন্য কুরবানি করা মহান আল্লাহর নির্দেশ। পবিত্র ঈদুল আযহা ও কুরবানি ইসলামের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ও আত্মত্যাগের অনন্য ইবাদত। আত্মত্যাগ ও মানবতার বার্তা নিয়ে প্রতিবছরই মুসলিম উম্মাহর সামনে হাজির হয় এই উৎসব। পবিত্র ঈদ উল আযহায় সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে দা, ছুরি, বঁটি, চাকু, চাপাতি, কাস্তে, কুড়ালসহ পশু কুরবানির জন্য প্রয়োজন পশুর মাংস কাটার লোহার তৈরি বিভিন্নসরঞ্জামের।আর তাই ব্যস্ততা বেড়ে গেছে নওগাঁরকামারপল্লীতে। দম ফেলার মত যেন সময় নেই  এ শিল্পের সাথে জড়িত কারিগরদের।


কামার পল্লীগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, হাপরের টানে কয়লার চুলায় দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। জ্বলে ওঠা আগুনের ফুলকিতে লোহাও হয়ে উঠছে সূর্যবর্ণ। দগদগে গরম লোহায় দিন-রাত হাতুড়ি পেটানোর ঠুকঠাক শব্দে মুখর কামার পল্লির এলাকাগুলো।শহর থেকে শুরু করে গ্রামে পর্যায়ে কামার পল্লীতে এখন টংটাং শব্দে মুররিত চারপাশ।


সবখানেই কর্মব্যস্ততার একই চিত্র।সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই ব্যস্ততা বাড়ছে দ্বিগুণ। কামাররা সকলেই এখন ব্যস্ত পুরোনো দা, ছুরি এবং বঁটিতে শাণ দিতে। কেউবা ব্যস্ত নতুন নতুন দা-ছুরি তৈরিতে। তাই দম ফেলার যেন সময় নেই তাদের। 


কয়েকজন কামারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্প্রিং লোহা (পাকা লোহা) ও কাঁচা লোহা দিয়ে উপকরণ তৈরি করা হয়। স্প্রিং লোহা দিয়ে তৈরি উপকরণের মান ভাল, তবে দাম বেশি। আর কাঁচা লোহার তৈরি উপকরণগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে কম। এ ছাড়াব্যবহার করা হয় এঙ্গেল, ব্লাকবার, রড, স্টিং, রেললাইনের লোহা, গাড়ির পাত ইত্যাদি, যা দিয়ে ছুরি, কাটারি, বটি, দা ও কুঠার ইত্যাদি তৈরি করে থাকি।মানভেদে পশুর চামড়া ছাড়ানো ছুরি ১০০ থেকে ২০০, দা ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা, বঁটি ২৫০ থেকে ৫০০, পশু জবাইয়ের ছুরি ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকা, চাপাতি ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 


কথা হয় মহাদেবপুরের উপজেলা সদরের কামারশিল্পের সাথে জড়িত রধুনাথ কর্মকারেরসাথে। তিনি বলেন, ঈদকে সামনে রেখে আমার দোকানে কর্মব্যস্ততা অনেক গুণে বেড়ে গেছে। এ মুহুর্তে দম ফেলারও সময় নেই। পাইকারি ব্যবসার সাথে সাথে স্থানীয় ক্রেতাদের অসংখ্য অর্ডার রয়েছে আমার। বছরের এই সময়টাতে রোজগার বেশি হলেও অন্য সময়ে তুলনামূলকভাবে রোজগার কম হয়। তিনি বলেন মূলত, এটি আমাদের পূর্বপুরুষের পেশা। আমার বাবা-দাদু কামারের কাজ করতো। তাদেরকে সহয়োগিতা করতেই একাজে আমার জড়িয়ে যাওয়া। 


নওগাঁ সদর উপজেলা হাঁপানিয়া বাজারের কারিগর মনোরঞ্জরন পাল বলেন, ২৫বছর ধরে এ পেশায় আছি। প্রতি বছরই কুরবানির ঈদের জন্য অপেক্ষায় থাকি আমরা। ঈদ মৌসুমে বছরের ভালো টাকা উপার্জন করা যায়। পশু জবাই ও মাংস প্রক্রিয়াজাত করতে লোহার তৈরী ধারালো অস্ত্রের প্রয়োজন হয়। আর এজন্যই ঈদকে ঘিরে কামারদের তৈরী দা, বঁটি, ছুরি, চাপাতি বিক্রি হচ্ছে এখন।


নওগাঁ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর শরিফুল ইসলাম খান বলেন, কুরবানির পশু জবাই ও মাংস প্রক্রিয়াজাত করতে লোহার তৈরী ধারালো অস্ত্রের প্রয়োজন হয়। আর এজন্যই ঈদকে ঘিরে কামারদের তৈরী দা, বঁটি, ছুরি, চাপাতি ইত্যাদি সামগ্রী বেশি হয়ে থাকে। মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপে গত দুই বছর এসব উপকরনের চাহিদা কমে ছিল।  ফলে অন্যান্য পেশার সাথে কামাররাও হতাশায় সময় পার করছিলেন। তাছাড়া আধুনিক যন্ত্র চায়নার তৈরী ষ্টীলের জিনিষ বাজার দখলে নেওয়ার কারনে প্রাচীন শিল্পের কারিগররা আদি পেশা পরিবর্তন শুরু করেছেন। তবুও বর্তমানে বাপ-দাদার এই পেশা অনেকে ধরে রেখেছেন। কামার শিল্প কিন্তু আমাদের ঐতিহ্য বহন করে। এ পেশার সাথে জড়িদের নানামূখী সুযোগ-সুবিধা করে দিতে ও তাদেও এই পেশাকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এই এই শিক্ষাবিদ।


বিসিক জেলা কার্যালয় এর সম্প্রসারণ  কর্মকর্তা ওয়ায়েস কুরুনী বলেন, নওগাঁ জেলায় বর্তমানে প্রায় ৩০০ কারিগর রয়েছে কামার শিল্পের সাথে জড়িত। তবে এ শিল্পের জড়িতদের সংখ্যা কমেছে। গত বছর চারশোর মত ছিল।  বর্তমানে আধুনিক যন্ত্র ষ্টীলের জিনিষ বাজার বিক্রি হওয়ার কারনে অনেক কারিগর এ পেশা পরিবর্তন করছে। বিসিক কার্যলয় থেকে আমরা প্রক্ষিণ ও ঋণসহয়াতা প্রদান কওে থাকি। যদি কোন কারিগর চায় তবে আমারা তাকে অবশ্যই ঋণ প্রদান করার উদ্যোগ গ্রহণ করবো।