মৃত্যু কামনা নাকি সুস্থতার প্রতিক্ষা? (পর্ব ৬)

নিজস্ব প্রতিবেদক
ইনিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ৯ই সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৯:৩৬ অপরাহ্ন
মৃত্যু কামনা নাকি সুস্থতার প্রতিক্ষা? (পর্ব ৬)

রোহানের শাশুড়িকে আইসিইউতে আনার সাথে সাথে ৬/৭ জন ডাক্তার নার্সের তৎপরতা শুরু হয়ে গেল। বিশাল এক ফর্দ ধরিয়ে দিলেন ডাক্তার, যাতে ছিল বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম সাথে কিছু ওষুধ। কিছু ওষুধ হাসপাতাল থেকে দিলেও বেশিরভাগ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে আসার পর ডাক্তার, রোহান-রেনুসহ আসে পাশের সবাইকে রুম থেকে বের হয়ে যেতে বললেন। রোগীকে লাইফ সাপোর্ট দিতে হবে। একজন অপেক্ষাকৃত তরুন ডাক্তার রোগীকে লাইফ সাপোর্ট গিয়ার, ইউরিন ক্যানুলা, ক্যাথেটাল পড়ালেন।



৪৫ মিনিট ধরে এই কর্মযজ্ঞ চলল। কাজ শেষে একজন নার্স আবার সবাইকে ভিতরে আসতে অনুমতি দিল। রোহান আর রেনু আইসিইউর ভিতরে গিয়ে দেখল, মায়ের দুই পাটি দাতের মাঝখানে একটা প্লাস্টিকের শক্ত নল ঢুকানো হয়েছে যাতে জিভে কামড় লাগে না যায়, শ্বাস প্রশ্বাস চলাচলের জন্য গলার মধ্যে দিয়ে একটা পাইপ শ্বাসনালীর মধ্যে পর্যন্ত এবং খাবার খাওয়ানোর জন্য আরেকটা পাইপ নাক দিয়ে পাকস্থলীর ভিতর পর্যন্ত ঢুকানো ছিল। গলার পাইপটা ভেন্টিলেটর এর সাথে লাগানো। ভেন্টিলেটর মেশিনে মিনিটে ১৬ বার দম নেয়ার এবং ৭০ লিটার অক্সিজেন ফ্লো সেট করা আছে। চারদিকে মেশিনগুলোর প্যা-পু আওয়াজ আতংকের মাত্রা আরো বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। 



দু-তিন দিন নির্ঘুম রাত কাটানো রোহান, রেনু ও শাওন এখন পুরাই বিধ্বস্ত। শাওন রেনুর ছোট ভাই। কারো খাওয়া নেই, নেই গোসল। কোভিড ইউনিটে মাস্ক খুলে খাওয়াটা যে অনেক ঝুকির তা তো নতুন করে বলার কিছু নাই। এরই মধ্যে মাঝে মাঝে ডান পাশের রোগীর মনিটর আবার কখনও বাম পাশের রোগীর মনিটরের দিকে তাকিয়ে সময় পার করছে তারা। গুগল সার্চ করে করে কোন মেশিনের কি কাজ তা বোঝার চেস্টা করছে রোহান। আসলে স্ত্রী রেনুর প্রশ্নের উত্তর দিতেই গুগলের সাহায্য নিতে হচ্ছে তাকে। ঘন্টায় ঘন্টায় বিপি, পালস, স্যাচুরেশন, তাপমাত্রা, সুগার মেপে নোট নিচ্ছে। রেনু তার মায়ের বুকের উপর মাথা রেখে মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। কোন কথাই সে শুনছে না। এখন তার কোন সংক্রমণের ভয়ও নেই। হয়ত ভাবছে যদি মা-ই না থাকে, তাহলে বেচে থেকে কি হবে? 



ভেন্টিলেটর লাগাতে গিয়ে ভালই ব্লেডিং হয়েছে, তাই মায়ের রক্ত মাখা মুখটা অনেক যতœ করে পরিস্কার করে দিচ্ছে রেনু। আর কানের কাছে গিয়ে বলছে 'মা তুমি খুব তারাতারি সুস্থ হয়ে যাবে। তোমাকে আমাদের গাড়িতে করে অনেক জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাব। অনেক কথা বলার আছে মা তোমাকে, তুমি সুস্থ হও। মা তোমাকে যে ভালবাসি, তাও তো এখনো বলতে পারিনি। মা তোমার এত অভিমান আমার সাথে। মা একটু চোখ মেলে আমাকে দেখ।' আর কিছুক্ষন পর পর রেনুর ছোট ভাই শাওন ও মা! মা! বলে চিৎকার করে উঠে।



এ দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে রোহান বাইরে গিয়ে পায়চারি করছে। স্মৃতিপটে ভেসে আসছে ৬/৭ বছর আগের কথা। রোহান শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে গেছে শাশুরি টেবিল ভর্তি রান্না সাজিয়ে বসে খাইয়েছেন, খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসে ছিলেন যেন কোন কিছু বাদ না যায়। স্বামীহারা ভদ্রমহিলা নিজেই বাজার করতেন, নিজের হাতে রান্না করে মানুষকে খাওয়াতে খুব পছন্দ করতেন। আর কেউ যদি তার রান্নার প্রশংসা করত তাহলে তো কথাই নাই। পারলে প্রতিদিন তাকে ধরে এনে খাওয়াবেন। 



রোহান ভাবে এবার সুস্থ হলে শ্বাশুড়ির রান্না খেয়ে অনেক বেশি প্রশংসা করবে। পরক্ষণেই ভাবে আর কি কখনো শাশুড়ির হাতের কুমড়া বড়া ভর্তা আর আলুর ডাল দিয়ে নরম রুটি খেতে পারবে? ভাবতে ভাবতে চোখটা ছল ছল করে উঠে রোহানের। প্রতি বছর জামাইকে লিচু না পাঠালে তার পেঠের ভাত যেন হজম হত না। আর কি শাশুড়ির পাঠানো লিচু খেতে পারবে তারা? রোহান মনে মনে দোয়া করে আরো ৫০ বছর যেন আপনি আপনার সন্তানের জন্য লিচু পাঠাতে পারেন মা। (চলবে)

----- লেখকঃ আব্দুল হালিম, সহকারী পুলিশ কমিশনার, বাংলাদেশ পুলিশ।