মৃত্যু কামনা নাকি সুস্থতার প্রতিক্ষা? (পর্ব-২)

নিজস্ব প্রতিবেদক
সাখাওয়াত জামিল সৈকত (অতিথি লেখক)
প্রকাশিত: সোমবার ৩০শে আগস্ট ২০২১ ০৫:৫৮ অপরাহ্ন
মৃত্যু কামনা নাকি সুস্থতার প্রতিক্ষা? (পর্ব-২)

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রোহানের শাশুড়িকে বহনকারী এম্বুলেন্স এসে পৌঁছাল হাসপাতালের সামনে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা রোহানের ফোন পেয়ে মেডিকেলের ওয়ার্ডের মাহিন এবার তার টিম নিয়ে দৌড়ে আসল। টিম বলতে মাহিন আর একটা হ্যাংলা পাতলা গরনের ছেলে, নাম লিটন। লিটনের বয়স ১৮/২০ বছর হবে। গায়ে ১ তোলা শক্তি আছে বলে মনে হয় না। কে ধরবে? কে নামাবে? এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে, রোগীর কাছে এসে ধরতে চাইছে না। রোহান কারো অপেক্ষা না করে নিজেই সেই হ্যাংলা ছেলেটাকে নিয়ে তার অচেতন শাশুড়ি কে এম্বুলেন্স থেকে নামালো। এর মধ্যে মাহিন রোগী ভর্তির সকল আনুষ্ঠানিকতা করে দিল। 



শাশুরির অচেতন মুখটা দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিল না রোহান। উপরে উপরে পাহাড়সম দৃঢ়তার ভান করলেও ভিতরে ভিতরে ভেংগে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল সে। মাস্কের আড়ালে চোখের পানি গড়িয়ে মেল্ট ব্রাউন সার্জিক্যাল মাস্ক ভিজে যাচ্ছিল, চোখের জলে নাকের জলে মাস্কের ভিতরে একটা অন্যরকম অস্বস্তি তৈরি হয়েছে তার। রোহানের স্ত্রী চিৎকার করে কাঁদছে। রোগী ভর্তি করাবে নাকি স্ত্রীকে সান্ত¡না দিবে বুঝে উঠতে পারছে না রোহান। যদিও ট্রায়াজের দায়িত্বে থাকা ডাক্তার কালক্ষেপণ না করেই দ্রুত ভর্তি করিয়ে দিল কোভিড জেনারেল ওয়ার্ডে। 



সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাত ১২০০ টায় কোভিড ওয়ার্ডে রোগীর জায়গা হল। একটা ওয়ার্ডে আটটা বেড। বারান্দা থেকে রুম সবখানে রোগীদের ফেলা খাবারের উচ্ছিষ্ট ময়লা আবর্জনা। রুম থেকে টয়লেটে যাবার করিডোরে হাসপাতাল থেকে দেয়া খাবার ভাত, মাছ ও ডাল ছড়ানো। ব্লক হওয়া বেসিনে ফেলা খাবার পঁচে গলে একটা অসহ্যরকম দুর্গন্ধ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে কোন এক রোগী টয়লেটে যাবার পথেই মল ত্যাগ করে রেখেছে। সেটি আবার কেউ একজন পরিস্কার করতে গিয়ে পানি ঢেলে দিয়েছে ফলে খাবার আর মল মিলে যাচ্ছেতাই অবস্থা তৈরি হয়েছে। টয়লেটের অপরপাশে কোন এক রোগীর স্বজন এগুলো দেখে নিজেকে সামলাতে না পেরে বমি করে দিয়েছে। বমির অর্ধগলিত রুটি, সবজি, হাসপাতালের ফেলে দেয়া খাবার আর মানুষের মল মিলে একাকার। কি আর করা মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তদের এর চেয়ে ভাল পরিবেশে চিকিৎসা নেয়ার খরচ বহন করা সম্ভব নয় বলে এটুকু তো সহ্য করতেই হবে।



একটি ব্লকে ১০ টা ওয়ার্ড সব মিলিয়ে রোগির সংখ্যা কম বেশি ১০০ জন হবে, ডিউটি ডাক্তার একজন, নার্স দুই-তিনজন। সুতরাং কে কার কি চিকিৎসা করবে? রোগী ভর্তির পর রোহান সকল টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে গেল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার খুব গভীর মনযোগ দিয়ে দেখে নতুন প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন যার মধ্যে বেশিরভাগই ইঞ্জেকশন (আইভি)। কারন রোগী তো ক্লিনিকালি কোমায় আছে। বিপত্তিটা বাধল ঘন্টায় ঘন্টায় সেগুলা পুশ করা নিয়ে। রাত ৩ টার দিকে এক ওয়ার্ড বয়কে কে খুব অনুনয় বিনয় করে ডাকল রোহান। 


কাচা ঘুম ভাংগায় লাল চোখে তাকিয়ে ওয়ার্ড বয় বলল ‘আপনেরা দিয়া লন’। 

রোহান বলল ‘আমরা তো পারি না ভাই।’ 

‘হিগোন লাগবো না’ সাথে সাথে উত্তর ওয়ার্ড বয়ের। 

রোহান আর কথা না বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল ‘নার্স কোথায়? ওয়ার্ড বয়ের সোজা উত্তর ‘তা আমি কেমতে কমু’। 



করোনা ওয়ার্ডে সবাই যেন কখন ডিউটি শেষ হবে, আর ডিউটি শেষ হলেই বাঁচে- এই মানসিকতার। রোহান ভাবে রোগী তার শাশুড়ি হলেও হাসপাতালের স্টাফদের কাছে তো অন্য আর দশ জনের মত। গত দুই বছর যাবত এই ওয়ার্ডের ডাক্তার-নার্স এই যুদ্ধই করে যাচ্ছে, আর কত? একে তো করোনা ইউনিটে কেউ কাজ করতে চায় না। কে চায় নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিংগন করতে? কে চায় তার পরিবারকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে? তার উপর জনবল সংকট তো আছেই। (চলবে)

----- লেখকঃ আব্দুল হালিম, সহকারী পুলিশ কমিশনার, বাংলাদেশ পুলিশ।