১৮ ডিসেম্বর নওগাঁয় উড়েছিল বিজয়ের পতাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক
রিফাত হোসাইন সবুজ, জেলা প্রতিনিধি, নওগাঁ
প্রকাশিত: শনিবার ১৮ই ডিসেম্বর ২০২১ ০৯:৫৬ অপরাহ্ন
১৮ ডিসেম্বর নওগাঁয় উড়েছিল বিজয়ের পতাকা

১৬ ডিসেম্বর সারাদেশে বিজয় দিবস পালিত হলেও মহান বিজয়ের দিবসের দুই দিন পর ১৮ ডিসেম্বর নওগাঁকে হানাদার মুক্ত ঘোষনা হয়। এদিন প্রায় দুই হাজার পাকিস্থানি সশস্ত্র সেনাবাহিনী যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে নওগাঁ হানাদার মুক্ত হয়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনার পর ২১ শে এপ্রিল পর্যন্ত মুক্ত ছিল নওগাঁ। পরের দিন ২২ এপ্রিল নওগাঁ পাক হানাদারদের দখলে চলে যায়। পরবর্তীতে পাক হানাদার বাহিনীরা জেলার বিভিন্ন স্থানে হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ বিভিন্ন তান্ডব চালায়। শত শত মুক্তিকামী  মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী। জেলার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হয় পাক বাহিনীর।


সর্বশেষ ১৯৭১ এর ১০ ডিসেম্বর জেলার রাণীনগর উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী বগুড়ার জেলা আদমদিঘী উপজেলার সান্তাহার রেলওয়ে জংশন শহর ১২ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয়। এসময় রানীনগর ও সান্তাহারে অবস্থানরত পাক বাহিনী ও অবাঙ্গালীরা ১৪ ডিসেম্বর রাতের মধ্যে নওগাঁ শহরের পার-নওগাঁ, কেডি স্কুলে আশ্রয় নেয়। এ সময় হানাদার বাহিনী নওগাঁ ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, সাবেক থানা চত্বর,আদালত পাড়া ও এসডিও বাসভবন চত্বরে আত্মরক্ষামূলক প্রতিরক্ষা বেষ্টনী গড়ে তোলে।

 

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্থানী সেনাবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে। এ খবর শোনার পরও নওগাঁয় পাকিস্থান সেনাবাহিনী অত্মসমর্পণ করবে না বলে ঘোষণা দেয়। এতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জালাল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৭টার দিকে প্রায় ৩৫০জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নওগাঁ শহর ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধারা ওইদিন শহরতলীর জগৎসিংহপুর ও খলিশাকুড়ি গ্রামে  অবস্থান নিয়ে পাক বাহিনীর উপর আক্রমন চালায়। এসময় পাকা হানাদাররা ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে । এভাবে একটানা রাত ৮টা পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১৮ ডিসেম্বর শনিবার সকালে বগুড়া থেকে অগ্রসরমান ভারতীয় মেজর চন্দ্রশেখর, পশ্চিম দিনাজপুর বালুরঘাট থেকে পিবি রায়ের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী নওগাঁয় প্রবেশ করলে হানাদার বাহিনীর আর কিছুই করার ছিল না। ফলে সকাল ১০টার দিকে প্রায় দুই হাজার পাকসেনা নওগাঁ কেডি স্কুল থেকে পিএম গার্লস স্কুল, সরকারি গার্লস স্কুল, পুরাতন থানা চত্বর এবং এসডিও অফিস থেকে শুরু করে রাস্তার দু’পাশে মাটিতে অস্ত্র রেখে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে নতমস্তকে আত্মসমর্পণ করে।


তৎকালীন নওগাঁ মহকুমা প্রশাসক সৈয়দ মার্গুব মোরশেদ মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীকে স্বাগত জানান। বর্তমান পুরাতান কালেক্টরেট (এসডিও) অফিস চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেখানে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা পতাকার প্রতি সালাম জানিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। ফলে নওগাঁ হানাদারমুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর।


বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নওগাঁ জেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হারুন অল রশিদ জানান, ১৬ থেকে ১৮ ডিসেম্বর, এ দুই দিন আমাদের কাছে ছিল খুবই ভয়াবহ। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় বোঝা যাচ্ছিল না কোথায় কী হচ্ছে। ১৮ ডিসেম্বর বগুড়া থেকে ভারতের মেজর চন্দ্র শেখর ও তার দল এবং পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাট থেকে পি বি রায়ের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী নওগাঁয় প্রবেশ করে। চূড়ান্ত হার মানে হানাদার বাহিনী। সেদিন সকাল ১০টার দিকে প্রায় দুই হাজার পাকিস্তানি সেনা শহরের পিএম গার্লস স্কুল, সরকারি গার্লস স্কুল, পুরাতন থানা চত্বর ও এসডিও অফিস এলাকায় রাস্তার দু’পাশে অস্ত্র রেখে আত্মসমর্পণ করেন। এসডিও অফিস চত্বরে ওড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালনের পাশাপাশি ১৮ ডিসেম্বর ‘নওগাঁ হানাদার মুক্ত’ দিবস সরকারিভাবে পালন করা প্রয়োজন। দিবসটি পালন করা হলে তরুন প্রজন্মরা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবেন।


এইদিন সকালে শহরের প্রধান প্রধান সড়কে বণার্ঢ্য শোভাযাত্রা প্রদক্ষিনসহ এটিএম মাঠে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়াদৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সামাজিক সংগঠন একুশে পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট ডি এম আব্দুল বারী।